বাবুই পাখি গণহত্যার বিচার চাই
'কতটা নির্দয় হলে মানুষ এমন করতে পারে' লেখাটি কোনোভাবেই এমন মানুষকেন্দ্রিক মুখস্থ বুলি দিয়ে শুরু হচ্ছে না। প্রজাতি হিসেবে মানুষ তো এক নিষ্ঠুর নির্দয় প্রাণীই। লুণ্ঠন, রক্তপাত, দখল আর দাঙ্গা তো মানুষেরই ইতিহাস। বনরুই কিংবা সজারু সমাজে এমন নজির বিরল। শকুন কি সাপের সমাজেও এমন কাণ্ড নেই।
মানুষের হিংসার আগুন কোনো মহামারি মানে না। করোনাকালেও মানুষ নৃশংসই থেকেছে। বন্যপ্রাণের প্রতি নিষ্ঠুরতা এক বিঘতও কমেনি মানুষের। নিদারুণভাবে এই নিষ্ঠুর মানুষদের এক বড় অংশই বাংলাদেশের গ্রামে বসবাস করছেন। এমন নয় যে, তারা প্রাণ-প্রকৃতির সাথে হাজার বছর বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা যন্ত্রনির্ভর কোনো শহুরে প্রজন্ম বা ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা কোনো এলিয়েন। গ্রাম-গঞ্জের আলো-হাওয়ায় বড় হওয়া এই সময়ে তরুণ প্রজন্ম এরা। কেবল এদের হাতে আছে মোবাইল ফোন আর সেই ফোনে আছে এক 'বিশ্বায়িত ভার্চুয়াল হাতছানি'।
মূলত গ্রাম ও মফস্বলের এই মানুষেরাই হরদম শামুকখোল কি শিয়াল, বনবিড়াল কি বানর হত্যা করে সেইসব খুনখারাবির ছবি ফেসবুকে দিয়ে উন্মত্ত হচ্ছেন। যেন আরেক ব্রিটিশ উপনিবেশকাল। বন্দুক দিয়ে বাঘ কি হরিণ মেরে লাশের ওপর বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা পাষণ্ড ব্রিটিশ শাসক।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী হত্যাকারীদের অন্তরে কি তাহলে সেই উপনিবেশিক খুনখারাবির জ্বালা রয়ে গেছে? নাকি কোনো নিদারুণ হীনমন্যতা বা চরম আফসোস ঢাকতে আর কারোর সাথে না পেরে পাখি কি বনবিড়ালের ওপর হামলে পরার বাহাদুরি? তার মানে, আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কি এমন বন্যপ্রাণী হত্যাকারী প্রজন্মের হাতেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তুলে দিতে চায়? প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি নির্দয় শহুরে করপোরেট প্রজন্ম তো ঢের আগেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে প্রকৃতির মায়া থেকে। বর্তমান পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র তাহলে কি আমাদের বন্যপ্রাণের প্রতি নতজানু হওয়ার কোনো শিক্ষাই দেয় না?
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু যেমন স্তব্ধ করেছে, আরও বেশি বিমর্ষ হয়েছি বন্যপ্রাণীর প্রতি মহামারিকালে মানুষের নিষ্ঠুরতা দেখে। করোনাকালে ২০২০ সনের মার্চ থেকে জুন অবধি ২৮৮টি বন্যপ্রাণী হত্যা করেছে মানুষ। এই পরিসংখ্যান কী ইঙ্গিত দেয়? দুনিয়াজুড়ে চলছে নির্দয় মহামারি। নিথর হয়ে আছে চারধার। মহামারির সকল শংকা আর আহাজারিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে একজীবনের পাশে আরেকজীবনের কোনো সখ্যতা না গড়ে মানুষ হামলে পড়েছে বারবার। হয় মানুষের সংসারে, নয় বন্যপ্রাণের সীমানায়। শাল্লার নোয়াগাঁও কি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানুষ চুরমার করে দিল মানুষেরই খতিয়ান। আবার এই মানুষই আমফান ঝড়ে আশ্রয় নেয়া ২০০ শামুকখোল পাখির বাসা ভেঙে তাদের হত্যা করল। সিলেটের হরিপুরে করোনা মহামারির ভেতরেও বুনো পাখির লাশের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মানুষ।
মানুষ এত কিছু পারছে, এত বড়াই আর এত বাহাদুরি। কিন্তু নিদারুণভাবে চোখে দেখা যায় না অদৃশ্য এক করোনাভাইরাসের হাতে জিম্মি হয়ে আছে মাসের পর মাস। চলমান এই মহামারি থেকেও কি মানুষ কিছুই শিখবে না? মানুষের এই বেমানান অহেতুক বাহাদুরি যে কোনো কাজের না, তা মানুষের বোঝা জরুরি। একবার নিজের আয়নার সামনে দাঁড়ানো জরুরি। নিজেকে প্রশ্ন করা জরুরি। মনের গভীরে জমে থাকা ক্ষত ও অহেতুক বাহাদুরি সারানো জরুরি। হয়তো এর জন্য দরকার হতে পারে দীর্ঘ চিকিৎসা কিংবা প্রকৃত পাঠচর্চা? আর তা না হলে সুনামগঞ্জে পুড়বে মানুষের গ্রাম আর ঝালকাঠিতে বাবুই পাখির ঘর।
বাবুই পাখি গণহত্যা
সাম্প্রতিক বাবুই পাখি গণহত্যার খবর প্রথম জানতে পারি 'Stand for our Endangered wildlife (SEW)' নামের এক বন্যপ্রাণী সুরক্ষামঞ্চ থেকে। শ্রীমঙ্গলভিত্তিক তরুণ বন্যপ্রাণপ্রেমীদের এই মঞ্চ দীর্ঘদিন ধরেই বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষা দিতে রাতবিরেতে ছুটে যাচ্ছে দেশের নানাপ্রান্তে। 'ঢাকাপোস্ট' নামের এক অনলাইন নিউজপোর্টালের একটি খবর তারা পোস্ট করে। ১১ এপ্রিল ২০২১ তারিখের গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব দিয়ে এই গণহত্যার খবরটি প্রচারিত হয়।
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ভৈরবপাশা ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে এই নৃশংস গণহত্যা ঘটেছে শুক্রবার জুম্মার নামাজের আগে ৯ এপ্রিল ২০২১ তারিখে। গ্রামের জালাল সিকদার নামের এক দোকানি লম্বা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তালগাছ থেকে বাবুই পাখির বাসা আছড়ে ফেলে। এ সময় দিগ্বিদিক ভয়ে পাখিরা ওড়াওড়ি শুরু করে। বাঁশের মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে বাবুই পাখির বাসা ছাড়খাড় করে দেয়। দাউ দাউ আগুনে ছাই হয়ে যায় বাবুই পাখিদের এক বড় গ্রাম। বড়পাখিরা বাসা ছেড়ে যেতে পারলেও ডিম আর ছানাগুলি কোথাও যেতে পারেনি। মানুষের হিংসার আগুনে দগ্ধ হয়েছে।
গণমাধ্যমে পড়ে যাওয়া পাখি ছানাদের বীভৎস লাশের ছবি ছাপা হয়েছে (যদিও নৈতিকতার দোহাই দিয়ে এইসব গণমাধ্যম মানুষের লাশের ছবি ছাপে না)। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই গণহত্যার খবর ও ছবি 'ভাইরাল' হয়েছে। মানুষ তীব্র নিন্দা জানিয়ে এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছে। ঈশ্বরকাঠি গ্রামের মানুষ এই বাবুইপাখি হত্যাকে মেনে নিতে পারেনি, দোষীর বিচার চেয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, বনবিভাগ সকলেই ঘটনাটি জেনেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরসহ প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী থাকা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত বাবুইপাখি হত্যাকারীর কোনো বিচার হয়নি। বা তাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।
হত্যাকারী জালাল সিকদারকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা জরুরি। প্রথম তার দীর্ঘ মনোচিকিৎসা দরকার। কারণ তিনি কোনোভাবেই 'সুস্থ স্বাভাবিক' মানুষ নন। গণমাধ্যম, গ্রামের মানুষ ও প্রশাসনের কাছে স্বীকার করেছেন তিনি 'রাগের মাথায়' এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কারণ বাবুই পাখির কিচিরমিচির ডাক তার অপছন্দ আর এই পাখিরা তার ক্ষেতের ধান খেয়ে ফেলে।
যিনি রাগের মাথায় এভাবে পাখিদের পুড়িয়ে মারতে পারেন, তিনি রাগের মাথায় আর কী করতে পারেন কে জানে? তাই চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলার পর তাকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি।
হত্যাকারী ক্ষমা পাবে কোন বিচারে?
১১ এপ্রিল নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে জালাল সিকদারকে ডাকা হয়, তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে যান। তারা বলেন, পাখির ছানা বা বাসায় আগুন দেওয়া হয়নি। ২/১টি বাসা পিটিয়ে ফেলা হয়েছে। ইউএনও রুম্পা সিকদার জালাল সিকদারকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। গণমাধ্যমকে তিনি জানান, 'পাখির বাসায় আগুন দেয়া বা ছানা পুড়িয়ে মারার ঘটনার কোন স্বাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। পাশাপাশি পাখির বাসা পিটিয়ে ফেলাসহ তার কৃতকর্মের জন্য জালাল সিকদার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। তাই তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। জালাল সিকদার আমাকে বলেছেন, তার প্রচুর ধান খেয়ে ফেলায় মাথা গরম হওয়ায় এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। বিষয়টি ক্ষমার যোগ্য মনে করায় তাকে ক্ষমা করা হয়েছে (দৈনিক সমকাল, ১১ এপ্রিল ২০২১)।'
জালাল সিকদারের পক্ষে যারা রাজাকারগিরি করছেন তাদের ভাষ্য কেন আমলে নিবে প্রশাসন? আর বন্যপ্রাণী হত্যার এই ঘটনা তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কীভাবে এমন নিষ্ঠুর গণহত্যাকে একজন সম্মানিত ইউএনও 'ক্ষমার যোগ্য' মনে করতে পারেন? কাদের হাতে আমরা বাংলাদেশের প্রশাসনিক ভার দিয়ে রেখেছি?
'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২' অনুযায়ী এই বাবুই পাখিদের নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারা অপরাধ। আর এই অপরাধের জন্য সুস্পষ্ট বিধান ও দণ্ড আছে। একজন ইউএনও কীভাবে দেশের বিদ্যমান পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী আইনকে লংঘিত করলেন? যেখানে পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ লড়াই করছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে কারণে বিশ্বব্যাপি প্রশংসিত, সেখানে নির্মম বাবুই গণহত্যার পর হত্যাকারীকে এভাবে 'ক্ষমা' করার ভেতর দিয়ে কী শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হবে?
সাম্প্রতিক এই বাবুই পাখি হত্যার জন্য অবশ্যই বনবিভাগের মামলা করা জরুরি এবং এর জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি প্রদান জরুরি। যাতে আর কেউ চাইলেই এভাবে কোনো বন্যপ্রাণ হত্যা না করতে পারে। বন্যপ্রাণ হত্যার পরও কীভাবে স্থানীয় প্রশাসন হত্যাকারীকে ক্ষমা করলেন, তাও খতিয়ে দেখা জরুরি।
বাবুই পাখিরে ডাকি
বাবুই পাখি গণহত্যার খবর প্রকাশ করায় স্থানীয় শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল শিপন হুমকিতে আছেন। পাখি হত্যাকারীর লোকজন তাকে নানা অপবাদ দিচ্ছে। অবশ্যই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, গ্রাম পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনকে আবদুল্লাহ আল শিপনসহ এই পাখি হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদকারী সকলের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সুরেলা গায়ক পাখি জগতের এক বিশেষ শিল্পী কারিগর বাবুই পাখি। দেশি, দাগি ও বাংলা- এই তিন জাতের বাবুইয়ের ভেতর কোনোমতে টিকে আছে দেশি বাবুই। নল-নটা, হোগলা-শণের বন বিলুপ্ত হওয়াতে দাগি ও বাংলা বাবুই প্রায় বিলুপ্ত। বড় তালগাছ, নারিকেল, খেজুর গাছে বাবুই পাখির বাসা নজর কাড়েনি, এমন মানুষ বিরল। রজনীকান্ত সেনের 'স্বাধীনতার সুখ' কবিতাখানি হয়তো অনেকেরই পড়া: 'বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুড়েঘরে থেকো করো শিল্পের বড়াই?'
গ্রামের বনবাদাড়ে দানা, বীজ, পতঙ্গ খায় বাবুই। স্থানীয় বাস্তুসংস্থান ও খাদ্যশৃংখলের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণসত্তা এই ক্ষুদে বাবুই। বরেন্দ্রর কোল আদিবাসীদের আবহাওয়া বিজ্ঞান বলে, বাবুই পাখির বাসার দরজা যেদিকে থাকে সে বছর কালবৈশাখী ঝড় আসে সেদিক থেকেই। এভাবে বাবুই পাখির বাসা থেকে মানুষ দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়। আর আমরা নির্দয়ভাবে ছানাপোনাসহ পুড়িয়ে মারছি এই পাখি।
লেখাটি যখন শেষ করব, তখন গণমাধ্যমে আবার খবর এলো 'পিরোজপুরে ২০০ বাবুইপাখি হত্যা'। পিরোজপুরের ইন্দুরকানির সদর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামে ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় বোরো মওসুমের ক্ষেতের ধান খাওয়ার অপরাধে শত শত বাবুই পাখির বাসা ভেঙেচুরে পাখিদের হত্যা করেছেন লুৎফর রহমান মোল্লা। এবারও কী ইউএনও হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেবেন?
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ দেশের সকল অঞ্চলের বাবুই পাখির জান-জমানা সুরক্ষা দিতে এখনই তৎপর হওয়া জরুরি।
-
লেখক: লেখক ও গবেষক; ই-মেইল: [email protected]