বাংলাদেশে হাতি মৃত্যুর থাকতে পারে লক্ষ কারণ!
আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অব নেচার)-এর রেড লিস্টে ইতোমধ্যেই এশীয় হাতিকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। তারপরও, এই শান্তশিষ্ট দানবেরা যেন প্রতিনিয়তই অকাল মৃত্যুর নিত্যনতুন রাস্তা খুঁজে বের করছে!
সকলেরই জানা হাতির সঙ্গে মানুষের বিরোধের কথা। এর কারণ, মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থে প্রায়ই বন্য জগতে অনধিকারপ্রবেশ করে। ফলে হাতিরা বিদ্যুতায়িত জিআই তার দিয়ে করা শস্যজমির বেড়া পার হতে গিয়ে তড়িতাহত হয়ে মারা যায়।
এছাড়া অনেক হাতি বুলেটের গতিপথের মাঝে পড়েও মারা যায়।
বন বিভাগের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, এবার ভারতীয় সীমান্তের কাছে শেরপুরে একটি বাচ্চা হাতি মারা গেছে অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও সংরক্ষণবাদীরা অবশ্য এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন, এবং প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন যে হাতিটি আসলে তড়িতাহত হয়ে মারা গেছে।
শেরপুরে চারজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি হাতি হত্যার মামলা দায়ের হওয়ার মাত্র একদিনের ব্যবধানেই, একই জেলার নালিতাবাড়ীতে এই বাচ্চা হাতিটির মৃতদেহ শনাক্ত হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জনদের দিয়ে মৃতদেহটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পর বন বিভাগ কর্মকর্তারা বিবৃতি দিয়েছেন, হাতিটি অত্যধিক পরিমাণে ধান খেয়ে মারা গেছে।
বিদ্যুতায়িত জিআই তারই সাম্প্রতিক সময়ে হাতি মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলেও, বন বিভাগ কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে বাচ্চা হাতিটি যেখানে মারা গেছে সেখানে বিদ্যুৎ নেই।
তবে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
ঘটনাস্থলেই মৃত বাচ্চা হাতিটি পরীক্ষা করেছেন ড. মনিরুল এইচ খান। তিনি বন্যপ্রাণী গবেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক। তার মতে, "হাতিটি বিদ্যুতায়িত হয়েই মারা গেছে। আমরা এটির শুঁড়ে বৈদ্যুতিক তারের কারণে সৃষ্ট ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেয়েছি।"
ড. খানের সঙ্গেই ছিলেন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার শাহানুল করিম চপল। তিনি একটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, "স্থানীয় জনগনের সাথে কথা বলে জানতে পারি যে শেষ রাতের দিকে হাতিটিকে বৈদ্যুতিক জেনারেটরের তারের শক দিয়ে মারা হয়েছে।
"হাতিটি যদি ধান খেয়েই মারা যাবে তাহলে কেন গর্ত করে মাটিচাপা দেবার চেষ্টা করা হচ্ছিল, আর তারা আমাদের দেখে কেন পালিয়ে গেল, কাদের এত দায়?"
বিভ্রান্তি রয়েছে হাতিটির লিঙ্গ নিয়েও। যদিও বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন এটি নারী ছিল, কিন্তু চপলের পোস্ট করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে মৃত হাতিটির পুরুষ জননাঙ্গ রয়েছে।
ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট (ডব্লিউসিসিইউ)-এর পরিচালক এ এস এম জহির উদ্দিন আকন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মাঝেমধ্যে খুব কমবয়সি হাতির লিঙ্গ নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়। তবে তিনি অবশ্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গেই একমত পোষণ করেছেন।
"দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে মৃতদেহটিকে পরীক্ষা করেছেন এবং মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করেছেন। বাহ্যিক উপসর্গ দেখে অন্যরা কী জানতে পেরেছেন, সে ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না।"
এই কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেছেন, সরকার হাতি নিধন বন্ধে বদ্ধপরিকর।
বাচ্চা হাতিটির মৃত্যুর মাত্র একদিন আগেই, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বন বিভাগ ও ওয়াইল্ডলাইফ কনজার্ভেশন সোসাইটি আয়োজিত 'বন্য প্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য দমনে আইন প্রয়োগ শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পরামর্শ সভা'-এ দাবি করেন, বন বিভাগের নেতৃত্বে বন্যপ্রাণী-সংশ্লিষ্ট অপরাধ দমনে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে।
ওই একই অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল বলেন, "বৈদ্যুতিক তার স্থাপনসহ কোনোভাবেই হাতিনিধনকে সরকার বরদাস্ত করবে না।"
তিনি আরও বলেন যে বন্য হাতি হত্যার এই চর্চা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তিনি থামবেন না।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে সচিব বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শেরপুরে পরপর কয়েকটি হাতির মৃত্যুর পর বিভাগীয় কর্মকর্তাদের রাজধানীতে তলব করা হয়েছিল।
গত দুই সপ্তাহের মধ্যে অন্তত সাতটি বন্য হাতি হত্যা করা হয়েছে দেশে এশীয় হাতির শেষ আবাসস্থল শেরপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। একটি হাতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদের মৃত্যু হয়েছে তড়িতাহত হয়ে কিংবা অন্যান্য অজানা কারণে।
এক শতক আগেও আমাদের দেশের অধিকাংশ জঙ্গলেই বন্য হাতি ছিল। কিন্তু এখন হাতেগোনা অল্প কয়েকটি জায়গায় তাদের দেখা পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে আইইউসিএন ও বন বিভাগের একটি যৌথ জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৬৮টি স্থানীয় বন্য হাতি, ৯৩টি অভিবাসী হাতি এবং ৯৬টি বন্দি হাতি ছিল। কিন্তু সেই জরিপের পর থেকে অবশিষ্ট হাতিদের মধ্যে অনেকগুলোকেই মেরে ফেলা হয়েছে।
ইতোমধ্যেই দেশে হাতির সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই হাতি নিধনের এই সর্বশেষ ঢেউটিকে দেশের হাতির অস্তিত্বের জন্য সাংঘাতিক আঘাত বলেই মনে করা হচ্ছে।