বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধুর অবদান
'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান'
-অন্নদাশঙ্কর রায়
'বঙ্গবন্ধু'- যে নাম না থাকলে বাংলাদেশ হতো না, তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশ গঠনে কল্যাণমূলক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনে এক মহানায়ক। আমরা এখন যা উপলব্ধি করছি, তিনি তার সময়ে যথার্থভাবে তা উপলব্ধি করেছিলেন। তার এক একটি চিন্তাকে স্পর্শ করলে মনে হয়, তখনকার সময়ে বসে তিনি এখনকার সময়গুলো দেখতে পেয়েছিলেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা ছিল তার দূরদর্শী কর্মকাণ্ডের অন্যতম। সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
জীববৈচিত্ৰ্য আমেরিকার জীব বিজ্ঞানী ই. এ. নরসে এবং তার সহযোগীদের সূত্ৰ অনুযায়ী জীববৈচিত্ৰ্য হল জল, স্থল সকল জায়গায় সকল পরিবেশে থাকা সকল ধরনের জীব এবং উদ্ভিদের বিচিত্ৰতা। পৃথিবী এগিয়ে চলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর পারস্পরিক নির্ভরতা নিয়ে। মূলত: উদ্ভিদ জগতের উপর নির্ভর করেই প্রাণী জগতের বেঁচে থাকা। এই নির্ভরতা কোথায়ও খাদ্যের প্রয়োজনে, কোথায়ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ,কখনও বা জীবনধারণের তাগিদে। এই শৃঙ্খলকে পারিভাষিক শব্দে বলা হয় বাস্তুসংস্থান। আর এই বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদেরই জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য
সবুজ শ্যামল প্রাণবৈচিত্র্যময় ছিল আমাদের এই বাংলাদেশ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে ও হচ্ছে। ফলে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবের দরুনত সমাজেও সৃষ্টি হচ্ছে নানারূপ অসংগতি। মানবসম্পদ উন্নয়নে ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ গঠনের সহায়ক হলো বন্য পশু-পাখি। বাংলাদেশের প্রাণিবৈচিত্র্যের এক বিশেষ ধরন আছে যা পৃথিবীর প্রাণিবৈচিত্র্যের একটা অংশ। এটা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। প্রাণিবৈচিত্র্যের গুরত্ব অপরিসীম। যেমন পাখি আমাদের ক্ষেত খামারের পোকা ধরে খায়, মলমূত্র জমিতে সার হিসেবে কাজ করে, পশু ফল খেয়ে ও ছিটিয়ে আমাদের বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধি করে। তদ্রুপ বন্য পশুর দ্বারা বন রক্ষা পায়। বন আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেয়, কাঠ দেয়, জ্বালানি-লাকড়ি দেয় এবং প্রাণবৈচিত্র্য বেঁচে থাকে। বিভিন্নভাবে আমরা প্রাণীকূল একে-অপরের উপর নির্ভরশীল।
বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি প্রেম
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু একজন সত্যিকার অর্থে প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবাদী ছিলেন। তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করলে তাঁর প্রকৃতি প্রেমের সুস্পষ্ট ছবি ফুটে উঠে।বঙ্গবন্ধুর লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে মধুমতী নদীর প্রসঙ্গ এসেছে একাধিকবার।
মনোয়ারুল ইসলামের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি -গণভবনে কোনো জেলা প্রশাসক এলে নানা কথার মধ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁকে প্রচুর গাছ লাগানোর কথা বলতেন। একবার তৎকালীন সিলেটের জেলা প্রশাসক এরশাদুল হক গণভবনে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার জেলায় যেখানে পতিত জমি আছে, সেখানে গাছ লাগাও না কেন?' তিনি উত্তর দিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন শমশেরনগর বিমানবন্দরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। সেখানে শত শত একর জমি কোনো কাজে আসছে না। এরপর বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে বললেন, 'এরশাদুল হককে কিছু টাকা দিয়ে দাও। ও কয়েক হাজার কমলালেবুর চারা লাগাবে।'
'কারাগারের রোজনামচা' বইয়ে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সালের কারাস্মৃতি থেকে জানা যায়, জেলখানার বাগান ও গাছপালার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। জেলখানায় অবাধে প্রবেশ করা পশুপাখি তার সাথী হয়ে গিয়েছিল। এক জোড়া হলুদ পাখির কথা কী সুন্দরভাবে তার লেখনীতে ফুটে উঠেছে, তা সত্যিই অকল্পনীয়। 'কারাগারের রোজনামচা' বইয়ে ১৯৬৬ সালের ১৭ জুলাইয়ের (রোববার) ঘটনায় তিনি লিখেছেন, 'বাদলা ঘাসগুলি আমার দুর্বার বাগানটা নষ্ট করে দিতেছে। কত যে তুলে ফেললাম। তুলেও শেষ করতে পারছি না।' জেলের মধ্যে বন্দি থেকেও তিনি প্রকৃতি-পরিবেশকে ভালোবেসেছেন। প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় টান অনুভব করেছেন।জেলের মধ্যে বন্দি থেকেও তিনি প্রকৃতি-পরিবেশকে ভালোবেসেছেন। প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় টান অনুভব করেছেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বৃক্ষরোপণ অভিযান উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে বিভিন্ন আহ্বান জানান। এ আহ্বানে তিনি গাছ লাগিয়ে বৃক্ষসম্পদ সম্প্রসারণের কথা বলেন।
পরিবেশ সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা
বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতিপ্রেমের কিছু ঘটনা আমরা, গণভবনের একজন কমর্কতা , মনোয়ারুল ইসলামের 'বঙ্গবন্ধু কালের সীমা ছাড়িয়ে' লেখায় খুঁজে পাই। বঙ্গবন্ধুর আদেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, এই ঘোড়ার ওপর বাজি ধরে বহু পরিবার ফতুর হয়ে গেছে। এটি আর চলবে না। তিনি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ডেকে বললেন, 'রেসিং ট্র্যাকের ওপর সারিবদ্ধভাবে নারকেলগাছ লাগাও।' একজন কর্মকর্তা আপত্তি জানিয়ে বললেন, ফলের গাছ লাগালে লোকজন সেই ফল চুরি করে খাবে এবং এ নিয়ে মারামারি হবে। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, 'জনগণের জমি, জনগণের গাছ। জনগণ যদি ফল খায়, আপনার- আমারআপত্তি কেন?'
বঙ্গবন্ধু পরিবেশ রক্ষার জন্য চর কুকরি মুকরি এবং নিঝুম দ্বীপে বনায়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সমুদ্র থেকে ভূমি পুনরুদ্ধারে কিছু কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর এই বনায়ন পরিকল্পনার মধ্যে মনোয়ারুল ইসলাম তাঁকে বললেন, "ভাওয়ালের গড়ের জঙ্গল থেকে যেভাবে শাল, গজারিগাছ কেটে নেওয়া হচ্ছে, তাতে কিছুদিন পর এই বন উজাড় হয়ে যাবে। এটি রক্ষা করার একমাত্র উপায় জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা।" এরপর বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ঢাকার জেলা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াতের সহায়তায় কার্যক্রমটি গ্রহণ করেন।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু কতৃর্ক প্রণীত আইন
জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে ১৯৭৩ সালে 'Bangladesh Wildlife (Preservation) Order 1973' অধ্যাদেশ জারি করেন। দেশের বন্যপ্রাণী বাঁচাতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার তাগিদে ১৯৭৪ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেন। মূলত এই আইনের মাধ্যমে দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে এক নব অধ্যায় সূচিত হয়। তিনিই ১৯৭২ সালে 'যৌথ নদী কমিশন' গঠন করে প্রথম পানি কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। স্বাধীনতা লাভের পরপরই তিনি নদীর নাব্য সংকট দূরীকরণে ড্রেজার সংগ্রহ করেন।
এ ছাড়া নৌপথ উন্নয়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি বহুমাত্রিক কর্মপরিকল্পনা হাতে নেন।তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৫ সালে দেশে 'ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম' প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে Water Pollution Control Ordinance, 1973 জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সূচনা করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বৃক্ষরোপণের যে ডাক দিয়েছিলেন, তাঁর এই দূরদর্শী ভাবনা বর্তমান সময়ে এসে কতটা সমসাময়িক, যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য; তা বলে শেষ করা যাবে না। কেননা, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ভুগছে পুরো বিশ্ব। দেশের প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সামাজিক আন্দোলন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ কালের গণ্ডি পেরিয়ে তাকে দিয়েছে অমরত্বের গৌরব।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য
উর্বর পলিমাটির জমি এবং উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে খুবই সমৃদ্ধ।সম্প্রতি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত 'এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা এন্ড ফনা অব বাংলাদেশ' কোষগ্রন্থে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশের এ পর্যন্ত উল্লিখিত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির প্রাথমিক তথ্যাদি সন্নিবেশিত হয়েছে।বিজ্ঞানীদের নানা হিসাব মোতাবেক প্রজাতি সংখ্যা (জীবন্ত) ৩০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি, তন্মধ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ শ্রেণীবিন্যস্ত হয়েছে এবং তাতে আছে প্রায় ২,৫০,০০০ উদ্ভিদ, ৭,৫০,০০০ কীটপতঙ্গ, ৪১,০০০ মেরুদন্ডী, বাকিরা অন্যান্য অমেরুদন্ডী, ছত্রাক, শৈবাল ও অণুজীব।এদেশে উদ্ভিদের প্রজাতি সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি, তন্মধ্যে ৩০০ বিদেশি ও ৮ একান্ত দেশিয়।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমাদের করণীয়
মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের এই প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতেই হবে। এ লক্ষ্যে আমরা দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি-
১। মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় হতে সারা দেশের সকল বিলে-ঝিলে মাতৃ মাছ রক্ষায় ছোট জলাশয় বা ডোবা তৈরি।
২। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় আনসার ভিডিপিদের সহায়তায় হাটে-বাজারে পাখি বিক্রি ও পাখির গোশত বিক্রি রোধ।
৩। ভূমি মন্ত্রণালয় হতে ১নং খতিয়ানভুক্ত জমিতে সারা দেশের সকল মৌজার বন্য পশু-পাখিদের আবাসস্থল গড়ে তোলা।
৪। তথ্য মন্ত্রণালয় হতে গণযোগাযোগ, রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারের ব্যবস্থা।
৫। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে দেশের সকল হাইস্কুলের সকল শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে পাখির উপকারিতা ও কীটনাশকের ভয়াবহতা সম্পর্কে পত্র পাঠের মাধ্যমে জ্ঞান দান।
৬। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় হতে গাড়ি চাপা দিয়ে বন্য পশু-পাখি না মারার ব্যবস্থা।
৭। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় হতে গণ নাটক ' পাখি কেন বন্ধু' প্রচার।
৮। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় হতে বন্য পশু ও পাখি রক্ষায় স্থানীয় সরকার কাঠামোকে উদ্বুদ্ধকরণ।
৯। গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে 'কীটনাশক মাত্রই বিষ-এর ব্যবহার মানুষের জন্য ক্ষতিকর' বাক্যটি লাল কালিতে কীটনাশকের লেবেলে লিখন বাধ্যকরণের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় হতে প্রস্তাব।
১০। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে বনে বসবাসকারিরা যাতে বন্য পশু-পাখি না মারে তার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম য গ্রহণ।
১১। বন্য পশু বানর রক্ষা কার্যক্রম চলছে।
১২। এয়ার গান নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকাভুক্তির মাধ্যমে আমদানি নিষিদ্ধকরণ অব্যাহত রাখতে হবে।
১৩। কৃষকের বন্ধু পাখি, তাই মহাপরিচালক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হতে আদর্শ কৃষকদের সমন্বয়ে সারা দেশে পাখি রক্ষায় ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।
১৪। আখ ক্ষেতে খয়ের গাছ রোপণের মাধ্যমে বিষমুক্ত চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি লাক্ষা উৎপাদন ও পক্ষীকুলের আশ্রয় ও খাদ্য নিশ্চিতকরণার্থে শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ও কৃষি গবেষণা অধিদপ্তরের সমন্বয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও আমাদের অস্তিত্ব
কোটি বছর আগে যতটা সবুজ ছিল আমাদের পৃথিবী, এখন অতটা নেই। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবী দূষিত নরকে পরিণত হচ্ছে। অবশ্য শুধু শিল্প বিপ্লবই দায়ী নয়; আরো অনেক কারণ রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমরা সচেতন না হলে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনও বদলেছে। সময়ের সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়েছে বহু গুণ, বেড়েছে চাহিদাও। এ কথা সবারই জানা যে মানুষের সব প্রয়োজন মেটানোর উৎস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রকৃতি। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের কারণে মানুষের চাহিদার আমূল বদল হয়েছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশের ওপর। বাসস্থান ও ক্ষেতের জন্য জায়গা করার জন্য দরকার অনেক জমি। মানুষ সেই জমির ব্যবস্থা করছে বনজঙ্গল সাফ করে। কারখানায় প্রস্তুত হয় মানুষের নিত্যদিনের সামগ্রী। সেই কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন না করে নদীতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সাগরে। আবার সেটা পুড়িয়ে পুড়িয়ে ক্ষতিকর ধোঁয়া বাতাসেও ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে সুবিধার জন্য যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে, তা মাটির ক্ষতি করছে। এভাবে পরিবেশের প্রত্যেকটি উপাদান দূষিত হচ্ছে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে।
পরিবেশের দূষিত উপাদান আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বনজঙ্গল নিধনের কারণে বাসস্থান হারাচ্ছে নানা প্রাণী। সাগরের পানি দূষিত হওয়ায় বিপন্ন অনেক জলজ জীবন। প্রাণীর এ বিপর্যয়ের মূল্যও কিন্তু আমাদের দিতে হবে। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, মৌমাছির সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে। পরাগায়নের মাধ্যমে আমাদের বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে মৌমাছির বিকল্প নেই। তাদের এই দুরবস্থা আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। আমরা যদি আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন না হই, তাহলে বেশি দিন পৃথিবীতে টিকতে পারব না। আমাদের ধ্বংস হবে সময়ের ব্যাপার।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু কন্যার অবদান
পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ' পুরস্কার পেয়েছেন।মুজিববর্ষ উপলক্ষে এ বছর একদিনে এককোটি গাছ লাগানো হবে।দেশব্যাপী এখন যে বৃক্ষ আন্দোলন, প্রতি বছর জুন মাসে বৃক্ষরোপণের যে উৎসব এবং বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়, তার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধুই।
"সব গ্রামকে সুন্দরভাবে সাজাতে কাজ করতে হবে "-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি কমপ্লেক্স সংলগ্ন 'জমি অধিগ্রহণ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ পরিকল্পনা' শীর্ষক উপস্থাপনা প্রত্যক্ষকালে এ কথা বলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
স্থানীয় সরকারি প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ৩৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে 'ভূমি অধিগ্রহণ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ পরিকল্পনা' শীর্ষক চার বছর মেয়াদি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
আবাদি জমি রক্ষার কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, জাতির পিতা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ফসলের জমি যাতে নষ্ট না হয় সেভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার পথ অনুসরণ করে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি নিতে হবে। শুধু ইট-সুরকির স্থাপনা নির্মাণ নয় বরং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে জনগণের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নদীতে অপ্রয়োজনীয় সেতু এবং বিলের পাশে সাগরপারের মতো উঁচু বাঁধ নির্মাণ না করার পরামর্শ দেন সরকারপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী ২৮১টি মিউনিসিপ্যালিটিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে- সড়ক উন্নয়ন, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ, ড্রেন নির্মাণ এবং ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, খাল খনন, পাড় বাঁধানো, পুকুর সংস্কার, সৌন্দর্যবর্ধন, বৃক্ষরোপণ। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পৌরসভার অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস এবং অপরিহার্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবেশগত উন্নয়ন করা হচ্ছে।
সুন্দরবন সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু
সুন্দরবন রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই বলে ঐতিহাসিক মন্তব্য করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবেও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। শুধু তাই নয় জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়েও দেশবাসীকে সতর্ক করেন সাবেক এই মহান নেতা।
বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্যে তিনি উপকূলে বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি বেশি করে নারকেল গাছ লাগাবারও আহ্বান জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর রাখা ঐতিহাসিক বক্তব্যের অংশ বিশেষ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
'আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশে দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না হয় তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায়—তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোনও উপায় আর নাই।'
জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছেন -
"মনে রেখো, মুখে হাসি বুকে বল
তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।"
কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর এই দিকনির্দেশনা মেনে চলতে পারছি না। আমরা ডিজিটাল মানুষ হয়েছি কিন্তু মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি।বিশ্বে ৭২ প্রজাতির শ্বাসমূলীয় গাছ রয়েছে, তার ৬৫টি আমাদের সুন্দরবনে রয়েছে। ১৯৫৯ সালে সুন্দরবনে প্রতি হেক্টর জমিতে ২৯৫টি গাছ ছিল, তা কমে ১৩০টিতে নেমে এসেছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। এবার সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে এই ধ্বংসের প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হবে। বাংলাদেশে মোট পানি সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার। এর ৭৫ শতাংশ আসে যৌথ নদী গুলো থেকে, ২০ শতাংশ পানি পাই বৃষ্টির পানি থেকে। ২ শতাংশ ভূগর্ভস্থ থেকে। অথচ আমাদের প্রয়োজনীয় পানির ৭৫ শতাংশ ভূর্গস্থ থেকে উত্তোলন করি। ফলে আমাদের অবশ্যই ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এ দিকে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় চিংড়িরেণু পোণা ও কাঁকড়া আহোরণ করতে গিয়ে তারা বিনষ্ট করছেন অন্যান্য প্রজাতির মাছ ও অণুজীব। এখানে হুমকির মুখে পড়েছে জীব বৈচিত্র্য। তবে জেলেদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে।তাদের মতে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে তবে রেণুপোনা আহরণের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের খাদ্য নষ্ট এবং বাস্তসংস্থান ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে অনেক অণুজীবের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনের ওপরে।
প্লাস্টিককেই এখন বলা হচ্ছে পরিবেশ আর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ। সকাল থেকে শুরু করে সারা দিনের জীবন যাপনে সব কিছুতেই প্লাস্টিকের ব্যবহার। পুড়িয়ে ফেলা ছাড়া এই অপচনশীল দ্রব্য ধ্বংস হয় না।
পরিসংখ্যান বলছেন, ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক তৈরি হয়েছে বিশ্বে। এর মধ্যে ৯ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়েছে। ১২ শতাংশ পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে। আর বাকি ৭৯ শতাংশ অর্থাৎ ৪.৯ বিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশেই জমা হয়ে আছে। বলা হয় এগুলো যদি সব একসাথে জমা করা হয় তাহলে তা মাউন্ট এভারেস্টের চেয়ে উঁচু হবে।
প্লাস্টিকের বড় একটি অংশই সমুদ্রে মিশে যায়। যা জলজ প্রাণীর খাদ্য চক্র নষ্ট করে। তাই বলা হয় যদি এই প্লাস্টিকের ব্যবহার মানুষ বাদ দিতো তাহলে হাজারো জলজ প্রাণীর প্রাণ রক্ষা করা যেত।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু পদক পুরস্কার
আগামী ২০ জুন, বৃহস্পতিবার 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা ২০১৯' এবং 'জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০১৯' অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে সংশ্লিষ্টদের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিরল, বিপদাপন্ন, বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, শিক্ষা-গবেষণা, সচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদিতে অসামান্য অবদান রাখায় চলতি বছর তিনটি ক্যাটাগরিতে চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে 'বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন-২০১৯' পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
এ বছর 'বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন-২০১৯'-এর 'বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা, খ্যাতিমান গবেষক, বিজ্ঞানী, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবাদী ব্যক্তি ও গণমাধ্যমকর্মী বা ব্যক্তিত্ব' (ক) ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পাচ্ছেন বন্যপ্রাণীর মা-খ্যাত সদ্যপ্রয়াত তানিয়া খান (মরণোত্তর)।
'বন্যপ্রাণী বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা' বিষয়ে (খ) ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বেনজির আহমেদ। এবং 'বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান' বিষয়ে (গ) ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পাচ্ছেন মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাল্লা গ্রামের 'পাখিবাড়ি'র প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার আহমদ স্বপন এবং 'পাখিবাড়ি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কমিটি'র সভাপতি ও তালিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ কান্তি দাস।
বিরল, বিপদাপন্ন, বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী প্রজাতি সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১০ সালে প্রথম এ জাতীয় পুরস্কার চালু করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
প্রাণীজগতের কোনো প্রাণীই চিরকালের জন্য পৃথিবীতে বিরাজ করতে আসেনি। প্রাকৃতিক ভাবেই বিবর্তনের একটি অন্যতম ধাপ হল প্রজাতির বিলুপ্তি। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়া যদি অত্যন্ত স্বাভাবিক বিবর্তনীয় ঘটনা হয়, তাহলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে এতো আলোচনা কেন?
পৃথিবীর আদি থেকেই অসংখ্য প্রজাতি আলোর মুখ দেখেছে একই সাথে হারিয়েও গিয়েছে কালের গহবরে। একই ভাবে, একটি প্রজাতির সামগ্রিকভাবে বিলুপ্ত হতে একটি নির্দিষ্ট সময় যাপন প্রয়োজন। গবেষণায় দেখা গেছে, একেকটি প্রজাতি পৃথিবীতে অন্তত ৫ থেকে ১০ লক্ষ বছর টিকে। এই সময়েই এরা বিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজাতির উন্মেষ ঘটায়। এভাবেই সুদূর অতীত থেকে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকছে। কোনো কারণে কোন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানে একটি বিশাল ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয়। আর এই শূন্যস্থান পূরণ হতে লেগে যায় আরো কয়েক লক্ষ বছর। আমাদের এই নীল গ্রহ ইতিমধ্যে পাঁচ বার বড় ধরনের জীবচিত্র্যের বিলুপ্তির মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এর আগের সব বারের চেয়ে বর্তমানের জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তির হারের প্রকৃতি অনেকাংশেই ভিন্ন। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং মানবসৃষ্ট কারণে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আরে এই ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার হার এতটাই বেশি যে, নতুন প্রজাতির উন্মেষে যে সময়টুকু প্রয়োজন, সেটা তারা পাচ্ছেই না। ফলে, প্রকৃতিতে শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে কিন্তু তা পূরণ করা হয়ে উঠছে না।
প্রাণীবৈচিত্র্যের সাথে জীবসম্পদ ও বাস্তুসংস্থানীয় সেবার নিবিড় সংযোগ রয়েছে। জীবসম্পদ শব্দটিই মূল কথা বলে দেয়। জীবজগতের বিভিন্ন প্রজাতি বিভিন্ন ভাবে আমাদের, অর্থাৎ মানবপ্রজাতির, সম্পদ হয়ে উঠছে। খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ কী না পাচ্ছি আমরা জীবজগৎ থেকে! সেই তুলনায় বাস্তুসংস্থানীয় সেবা কথাটি একটু অপরিচিত লাগতে পারে। প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের বিভিন্ন প্রজাতি নিজেদের টিকে থাকার জন্য যেসব জৈবিক কর্ম সম্পাদন করে, আর আমরা নিজেদের স্বার্থে সেগুলোর ব্যবহার করি। সেগুলোই হচ্ছে বাস্তুসংস্থানীয় সেবা। এই যে গাছ অক্সিজেন প্রস্তুত করে, সেটা তো তারা নিজেদের স্বার্থেই করে। মাঝে দিয়ে আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করছি। পতঙ্গ যে পরাগায়ন ঘটাচ্ছে, তা পতঙ্গ ও শস্যের নিজেদের টিকে থাকতেই জরুরি। মাঝে দিয়ে আমরা হচ্ছি সুবিধাভোগী। তো, এইভাবে জীব জগতের অন্যান্য প্রজাতি আমাদেরকে যে সেবা দিচ্ছে সেটার আর্থিক হিসেব করলে দেখা যায়, অংকটা নিতান্ত কম না। অস্ট্রেলিয়াতে শুধুমাত্র একটি প্রাণী প্রজাতি, কোয়ালার কারণে ১৯৯৭ সালে দেশটির পর্যটন বিভাগ প্রায় ৭৫০ লক্ষ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছে।মানুষসহ সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য একান্ত অপরিহার্য। আর এই ভারসাম্য বজায় রাখতে সঠিক সংখ্যায় সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনের স্বার্থে জীববৈচিত্র্যে রক্ষা করা আবশ্যক। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকার জন্য জীববৈচিত্র্য প্রয়োজন।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপায়
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপায় সমূহকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ইনসিটু এবং এক্সসিটু কঞ্জার্ভেশন। ইন-সিটু সংরক্ষণ বা স্বস্থানে সংরক্ষণ অর্থ হচ্ছে কোন প্রজাতির প্রাকৃতিক বসতির সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিকতায় টিকে থাকার মত জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধার ও রক্ষণ। এই পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক নিয়মে জীব প্রজাতি যেখানে জন্মে সেখানেই সংরক্ষণ করা হয়। যেমন- সুন্দরী গাছকে এবং রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কে সুন্দরবন এ এরুপ বাস্তুতন্ত্রে সংরক্ষণ করা হল ইন-সিটু সংরক্ষণ।
এক্স-সিটু সংরক্ষণ হল এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে জীবকে তার স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে দূরে এক কৃত্রিম জায়গায় নিয়ে এসে পালন করা হয়। এক্স সিটু সংরক্ষণ হল এমন একটি পদ্ধতি যার দ্বারা বিপদগ্রস্ত উদ্ভিদ এবং প্রাণী প্রজাতি তার নিজস্ব বাসস্থান থেকে এনে বিপদমুক্ত ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় আলিপুর চিরিয়াখানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর পালন ।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রাজনৈতিক অঙ্গীকার
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের জীব বৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বণ্য প্রাণী আমাদের দেশে রয়েছে। জীব বৈচিত্র রক্ষার প্রয়োজনীয় সব আইনি কাঠামোও দেশে রয়েছে। সম্প্রতি সংবিধানে জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বে যে ৭২ প্রজাতির শ্বাসমূলীয় গাছ রয়েছে, তার ৬৫টি আমাদের সুন্দরবনে রয়েছে। ১৯৫৯ সালে সুন্দরবনের প্রতি হেক্টর জমিতে ২৯৫টি গাছ ছিল, বর্তমানে তা কমে ১৩০টিতে নেমে এসেছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।
দেশে ভূমি ব্যবহার নীতিমালা করা হয়েছে। কৃষিজমি সুরক্ষা আইন হচ্ছে। একই রকমভাবে জলাশয়, বনভূমিগুলো যাতে ইজারা না দেওয়া যায়, সে জন্য একটি আলাদা খতিয়ান নম্বর থাকা উচিত। যা শুধু জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হবে, এমন আইন তৈরি করতে হবে। পরিশেষে,সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদেরও সোচ্চার হতে হবে।
উপসংহার
পরিবেশ বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে। জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা যতটা সম্ভব কমাতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দূষণের মাত্রা আরো কমবে। আমাদের পৃথিবীকে শুধু আমরাই বাঁচাতে পারব। প্রয়োজন শুধু ইচ্ছাশক্তি আর দৃঢ় সংকল্প। তাহলেই আমরা আমাদের অস্তিত্ব আরো অনেক বছরের জন্য নিশ্চিত করতে পারব। তাই আজ থেকে শপথ করি–
'জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা করি
সকলে মিলে সুন্দর স্বদেশ গড়ি।'
লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়