বোল্টনের বই ও মার্কিন নির্বাচন

জন বোল্টন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত তাকে আর স্বপদে রাখেননি। ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদ থেকে অপসারিত হন। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের সময় থেকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে শুরু হওয়া এই চরম হোয়াইট সুপরিমিস্ট রিপাবলিকান নানা সময় বহু পদ অলংকৃত করেছেন।
এই হোয়াইট সুপরিমিস্ট ট্রাম্পের দৃষ্টি কাড়ার জন্য প্রথম থেকেই ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পক্ষে ওকালতি করেছেন। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে যে সরকার মার্কিনীদের প্রতি ঠিক অনুগত নয়, এমন অবাধ্য সরকার (ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া সর্বত্র) পরিবর্তনের তত্ত্বদাতা তিনি। ভেনিজুয়েলায় সামরিক আক্রমণেরও মূল তাত্ত্বিক।
কিন্তু এক বছরের মাথায়ই বোল্টন তার হোয়াইট সুপরেমেসি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়ে যান। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও এই একই মতাদর্শের লোক। তারপরও ভেনিজুয়েলায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করেননি। তবে ইরান ও ভেনিজুয়ালাতে তথাকথিত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেন। তার এই অর্থনৈতিক অবরোধের অর্থ হলো: মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কোনো লেনদেন করা যাবে না। ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করে ইরানি তেল বিক্রিতে বাধা দেওয়া। এই একই অবরোধ আরোপ হয়েছে ভেনিজুয়েলার ওপরও। বিশ্বের এই দুই বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশকে বিশ্ব বাজারে তেল বিক্রি থেকে বিরত রাখতে পারলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে মার্কিন তেল কোম্পানি, সঙ্গে সুবিধা পাচ্ছে সৌদি তেল কোম্পানিও।
অর্থনৈতিক অবরোধের শিকার হচ্ছে ইউরোপও। রাশিয়া থেকে গ্যাস কেনায় অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প।
তবে এখানে মজার ব্যাপার হলো, জন বোল্টনের তত্ত্বে ট্রাম্প মনোযোগী হলেও, শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক টিকল না। ট্রাম্প তার মূল উপদেশগুলোর প্রধান অংশের বাস্তবায়ন করার পরও দুজনের রসায়ন কাজ করল না শেষ পর্যন্ত। ট্রাম্প বোল্টনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, তিনি কিউবা আর ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে আরও কঠোর হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বোল্টন সেটা হতে দেননি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ট্রাম্পের সমর্থন হারান বোল্টন। তার আগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যখন মার্কিন কংগ্রেসে ইম্পিচমেন্ট শুনানি চলছিল, তখন বোল্টন কংগ্রেসে স্বাক্ষী প্রদানে অস্বীকৃতি জানান। আবার সিনেটে যখন ইম্পিচমেন্ট শুনানি শুরু হয়, তখন মার্কিন সিনেটের ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানরা তা প্রতিহত করে।
অবশ্য বোল্টনকে তার আগেই ট্রাম্প তার পদ থেকে অপসারন করেছেন। বোল্টন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন। ফিলিস্তিনিরা যখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করে, বোল্টন তা আটকে দেন। বোল্টন এই আদালতের বিরুদ্ধে 'inaccurate, imbalance, excessive' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন।

বোল্টন বরখাস্ত হওয়ার পর পরই শুরু হয় নতুন নাটক। ট্রাম্পের সঙ্গে ১৭ মাসের রসায়ন ভেঙে যাওয়ার পর বোল্টন নানা গণমাধ্যমে ট্রাম্পবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করতে শুরু করেন। ট্রাম্প প্রশাসনে কাজ করার সময়সহ নানা বিষয় নিয়ে বই লিখতে শুরু করেন। বোল্টন বইটির নাম রাখলেন 'THE ROOM WHERE IT HAPPENED'।
বইটি বাজারে আসার আগেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে অংশ বিশেষ প্রকাশিত হয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। বইয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে: ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট 'শি'র কাছে ২০২০ সালের নির্বাচনে জয় লাভের জন্য সহায়তা চেয়েছেন। শি'কে অনুরোধ করেছেন, আমেরিকা থেকে সয়াবিন ও গম ক্রয় বৃদ্ধি করতে, তাহলে তার নির্বাচনে জয় পেতে সুবিধা হবে। মধ্য-পশ্চিম আমেরিকার রাজ্যগুলোর অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হওয়ায় ২০১৬ নির্বাচনে এই রাজ্যের চাষীরা ট্রাম্পের জয় সহজ করেছিল। এরসঙ্গে আরও অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য: যেমন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ট্রাম্পে কথাকথোপনের বিবরণী, ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডনের ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের অনুরোধ।
বোল্টনের বইটির প্রকাশনা আটকে দিতে ট্রাম্প আদালতে নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। ওয়াশিংটনের এক ফেডারেল আদালতে এই মর্মে আবেদন করা হয় যে, বইটিতে বোল্টন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয় বহু তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলতে পারে। তবে কাজ হয়নি এ আবেদনে। আদালত নিষেধাজ্ঞা দিতে অস্বীকার করে বরং বোল্টনকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তার বইয়ে যদি কোনো জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো তথ্য থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল অভিযোগ আনা হবে।
এই আদেশকে ট্রাম্প তার বিজয় বলে দাবী করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আদালত বইটি প্রকাশের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞ দেননি। এখন দেখার বিষয়, বোল্টনের হৈচৈ ফেলা এই বই আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক