প্রতিবেশী ভারতের বন্ধুত্ব

ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশসহ মোট সাতটি দেশের। সবচেয়ে বড় সীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। বাকি দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন,পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার, ভুটান ও আফগানিস্তান।
সীমান্তের দেশগুলোর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক (ধরা হয়) বাংলাদেশের। কিন্তু আসামের এনআরসি কিংবা বাঙালি খেদাও আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিকর, এরসঙ্গে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিয়মিত হত্যাকাণ্ড, ভারতের পার্লামেন্টে সিএএ বিল পাশের সময় বাংলাদেশকে ইসলামী দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা প্রভৃতি বিষয় বাংলাদেশের জন্য সুখকর ছিল না । সিএএ বিল পাশের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্ধারিত সফর বাতিল বাংলাদেশের জন্য বিরক্তির ছিল। অতীতে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার কিংবা মাওবাদীদের কাছে অবৈধ অস্ত্র সরবারহ পথ বন্ধ করার বাংলাদেশের উদ্যোগ ভারত কৃতজ্ঞচিত্তে মনে রাখেনি। মনে পড়ে, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বাংলাদেশের একাধিক উচ্চপদস্থ রাজনীতিক ও আমলা বিচারের সম্মুখীন হয়। ওসব অস্ত্র মূলত ভারতীয় ভূখণ্ডে সরবারহের জন্যই আনা হয়েছিল। বিপরীতে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্যের কথা সব সময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। বাংলাদেশ ভারতের অর্থনীতির স্বার্থে নৌ ও স্থলপথে পণ্য পরিবহণে ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি দিয়েও সুসম্পর্কের উদাহরণ রেখেছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সত্যিকারের গভীর ভাল সম্পর্ক ছিল ২০১৪ সাল পর্যন্ত, যখন কংগ্রেস নেতৃত্বে NDA ক্ষমতায় ছিল । ভারতের কেন্দ্রে বিজেপির আগমন এবং পশ্চিমবাংলায় তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশি দেশ ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে। বলা হয়ে থাকে মমতা ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের তিস্তা নদীর পানি চুক্তি হতে দেয়নি। কিংবা মমতা সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকের নিয়মিত হত্যার বিরোধিতাও কখনো করেনি। অন্যদিকে ভারতীয় গণমাধ্যম সবসময়ই সীমান্ত অনুপ্রবেশের গল্প প্রচার করে থাকে। অথচ সীমান্তে গরু পাচারের সঙ্গে উভয় প্রান্তের কর্মহীন মানুষই জড়িত। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রায় নিয়মিত বিরতিতে শুধু বাংলাদেশিদেরই হত্যা করে।
মমতা ব্যানার্জি তার রাজ্যে মুসলিম ভোট টানতে গিয়ে দরিদ্র, অশিক্ষিত মুসলমান জনগোষ্ঠীর মন জয় করতে গিয়ে ইমাম ভাতা নামক এক ভাতা চালু করেছে, যা মুসলমানদের আরও বেশি করে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ বাদে সীমান্তের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কেমন?
মুদ্রা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক আমেরিকার বিরোধী, বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প হিসাবে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে BRICS ব্যাংক গঠন করে চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা। এই বিকল্প ব্যবস্থাকে ভালোভাবে গ্ৰহণ করেনি আমেরিকা। আমেরিকা, তথা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে দুর্বল করা লক্ষ্যে নানারকম বাণিজ্যিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে অনেকদিন ধরেই। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া পাল্টা সুরক্ষা হিসেবে উভয়ই নিজ মুদ্রায় বাণিজ্য করার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করেছে। ভারতকেও এ দলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে চীন ও রাশিয়া।
চীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালে অরুনাচল সীমান্তযুদ্ধে ভারত পর্যুদস্ত হয়েছিল, আজও দুই দেশ সেই সীমান্ত বিরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। উভয়পক্ষ এখন পরস্পরের কাছ থেকে শুধু নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে শান্তি বজায় রেখেছে। ওদিকে ভারতশত্রু পাকিস্তানের পক্ষে চীন সব সময়ই সমর্থন জুগিয়ে আসছে, তা আরও স্পষ্ট হয় ১৯৭১ সালে । তবে সর্বশেষ, চীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কিছু সদিচ্ছা দেখিয়েছ, পাকিস্তানে অবস্থানরত মাওলানা মাসুদকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসাবে তালিকাভুক্ত করতে ভারতীয় উদ্যোগের বিরুদ্ধে তারা ভেটো প্রয়োগ করেনি। যদিও আগে বহুবার চীন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে ভেটো প্রয়োগ করেছে। গত বছর চীন বেজিংয়ে BRICS summit এর সময় সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে, মোদীকে সঙ্গে নিয়ে সম্মেলন করে। কিন্তু চীনের এসব সদিচ্ছায় সাড়া না দিয়ে মোদী হাত মিলায় ট্রাম্পের সঙ্গে। এরপর ট্রাম্পের ভারত সফর আর মোদীর আমেরিকা সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি সর্বজন জানা। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের ইসরাইল বহুকাল যাবৎ ভারতের অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। আর ট্রাম্প-মোদী জোট পৃথিবীতে এক নতুন মোড়কের জাতীয়তাবাদ শেখাতে চাইছে, তা আসলে ধর্ম ও বর্ণবাদেরই নতুন সংস্করণ।
মোদীর দল গোহত্যা নিয়ে উন্মাদনা দেখিয়ে ভারতকে নতুন মাত্রার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে প্রবেশ করিয়েছে, যে কারণে চীনকে গ্ৰহণ না করে আমেরিকাকে তার কাছের বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে এই কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েই ১০০ কোটি ডলারের আধুনিক হেলিকপ্টার ক্রয় চুক্তি করেছে ভারত। চীন- ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা মোদী-ট্রাম্প চক্র আটকে দিতেই সচেষ্ট। যে কারণে কোভিড-১৯ বিষয়ে চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের পক্ষেই দাঁড়িয়েছে মোদিজী। চীনের অব্যাহত সহযোগিতা-উদ্যোগ প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় হতাশ চীন। দুদেশের সম্পর্ক আবার ফিরে গেছে অরুনাচল বিরোধ পূর্ণ অবস্থায়। আর চীন ভারতের অচলাবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নেপাল।
একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল। বহুকাল ভারতের উপর নির্ভরশীল নেপাল আজ চরম বৈরী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী ভারতীয় রাজনীতি, ভারতীয় গণমাধ্যম কখনোই নেপালকে সমমর্যাদার আসনে দেখেনি, ফলে অতীতের সেই ক্ষোভ এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নেপালী বাহিনী সীমান্তে গুলি চালিয়ে ভারতীয় নাগরিক হত্যা করতেও কসুর করছে না । ১৯৬২ সালের চীন ভারত যুদ্ধের সময় কৌশলগত কালাপানি ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছিল নেপাল। তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর অনুরোধে নেপাল এটা করেছিল।
এরমধ্যে নেপালি কংগ্রেস দলের দীর্ঘকালের শাসনের অবসান ঘটিয়ে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসেছে। তারা নেপালের নতুন সংবিধান রচনা করে রাজতন্ত্র বিলোপ করেছে, এবং নিজেদের হিন্দু রাষ্ট্রের পরিচয় ত্যাগ করে, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান গ্রহণ করেছে। নতুন সংবিধান গ্রহণের সময় ভারতীয় মদহেসি সম্প্রদায়ের নেপালীরা এর বিরোধিতা করে। কিন্তু সংবিধান রচনার সময় জাতীয় সংসদের আসন সীমানা এমনভাবে বিন্যাস করা হয়েছিল যেন নেপালী মদহেসিরা নির্বাচনে কোনো ব্যক্তি সুবিধা না পায়। এরপর নেপালের ওপর নেমে এল দীর্ঘ অবরোধ। দীর্ঘদিন নেপালের পাহাড়ী জনগণের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে রাখল গেরুয়া পোশাকধারী বিজেপি সমর্থক মদহেসিরা। নেপাল পুরোপুরি ভারতের জ্বালানির উপর নির্ভরশীল ছিল তখন। নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছু আসত ভারত থেকে। অবরুদ্ধ নেপালের সাহায্যে তখন এগিয়ে আসে চীন। আকাশ পথে প্রয়োজনীয় সব রকম পণ্য সরবারহ করে। সর্বশেষ, নেপালি পার্লামেন্ট এই কোভিড -১৯ চলার সময় নিজ দেশের পার্লামেন্টে নতুন ভৌগলিক সীমারেখা পাশ করেছে, সেখানে ১৯৬২ সাল থেকে ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা মহাকালী নদীর উৎপত্তিস্থল কালাপানি ভুখণ্ডকে নিজেদের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে।
ভারত পাকিস্তান সম্পর্ক। বৃটিশ শাসকরা ভারত বিভক্তির সময় কাশ্মীরে যে বিরোধ সৃষ্টি করে গেছে তার কোন সমাধান এই দুই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীর কাছে নেই। পৃথিবীর অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশগুলোর কাছে অন্যতম অস্ত্রবাজার পরস্পর চিরশত্রু এই দুই দেশ। ভঙ্গুর অর্থনীতির ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে শিয়া, সুন্নী, আইসিস সব মতের সন্ধান পাওয়া যায়। এ কারণে প্রতিবেশি হিন্দু জাতায়তাবাদী ভারতের সঙ্গে কোনদিনই তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক হবে না, যতদিন না এই দেশ তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে বিদায় করবে। যতদিন সমাজকে ধর্ম প্রতিনিধিত্ব করবে, পরিচালিত করবে ততদিন পাক - ভারত যুদ্ধাবস্থা অব্যাহত থাকবে। ভারতীয় ধর্ম, দর্শন বর্ণবাদী, আবার পাকিস্তানীদের ধর্ম বিশ্বাসও ভয়ংকর। তার প্রমাণ পেশোয়ারের সামরিক স্কুলের কিশোর ছাত্রদের উপর তালেবানী জঙ্গি হামলা ।
ভুটানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শীতলই বলা যায়। চীনাদের উপস্থিতি যত ব্যপক হচ্ছে তাতে আর এই পাহাড়ী দেশটির সাথে ভারতের সম্পর্ক উষ্ণ থাকা সম্ভব হবে না। সীমান্তদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব বোঝা যায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে, বাংলাদেশের পাশে ভারত থাকেনি মিয়ানমারকে চীনের দিকে ঠেলে না দেওয়ার কূটনীতি থেকে। কিন্তু এই কূটনীতি কোনো কাজে আসেনি। বহু আগে থেকেই চীনের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে মিয়ানমারে। মিয়ানমারে বড় বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। দুই দেশের সম্পর্কও পরীক্ষিত।
সব মিলিয়ে এ কথা বলা যায় ভারতের চতুর্দিকে স্থল সীমানার দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির কোনো মধুর বন্ধুত্ব নাই । কখনও হবে কিনা সে বিষয়ে গভীর সন্দেহ রয়েছে। এজন্য সর্বতোভাবে দায়ী হিন্দুত্ববাদীতা ।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক