পুতিন কি স্ট্যালিন হতে চান?
১৯৫২ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ভ্লাদিমির পুতিনের জন্ম। এই শহরটি অতীতকাল থেকে রাশিয়ার অভিজাতদের শহর, যাকে কেন্দ্র করে জার রাজবংশ ৩০০ বছর তাদের শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছিল। এখানেই রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব! সংগঠিত হয়েছিল লেলিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে।
পৃথিবীর বহু দেশে ঘটনাটিকে "বিপ্লব ' নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল একটি সামরিক অভ্যুত্থান। জার রাজতন্ত্রের সামরিক বাহিনীর একটি অংশ জারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিয়ে বলশেভিক পার্টির সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে। পরিণতিতে জার সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। জারের পতনের পর ক্ষমতায় আসে বলশেভিক পার্টি। কিন্তু, খুব বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে পারেননি লেলিন। কথিত আছে, জারদের পরিবারের ৮৫ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই বিপ্লবের পরবর্তী সময় যা বিশ্ব বহুকাল জানতে পারেনি।
সেই শহরের জন্মগ্রহণকারী ভ্লাদিমির পুতিন তার শিক্ষাজীবন শেষে রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী কেজিবিতে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনের নানান প্রান্তে নানান গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন। বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গার সময় তিনি পূর্ব জার্মানির সোভিয়েত কনস্যুলেটে কর্মরত ছিলেন। এরপর সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যখন আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যখন বরিস ইয়েলৎসিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলে পুতিন তার নতুন কর্মজীবন শুরু করেন ক্রেমলিনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে। মস্কোতে স্থায়ীভাবে শুরু হয় তার কর্মজীবন। ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার দিকে ধাবিত হতে থাকেন তিনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে, তিনি ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৯৯ থেকেও ২০০৮ এই সময়কালে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। যে সময়ে তিনি রাশিয়াকে নতুন এক জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে গড়ে তোলেন। আর এই জাতীয়তাবাদী চেতনাই আজকের রাশিয়ায় তার একনায়কত্ব সৃষ্টি করেছে।
সোভিয়েত ভাঙনের জন্য দায়ী বরিস ইয়েলৎসিন, সে দেশের নাগরিকদের একটি বিরাট অংশ এটা বিশ্বাস করেন। বরিস ইয়েলৎসিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে রাশিয়াকে একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের অন্যতম আরও কারণ ছিল: তারমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখল করে বিপ্লব করার চেষ্টা ছিল অন্যতম, ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের ধ্যান-ধারণায়: সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া গেলেই কোনো ভূখণ্ডে বিপ্লব করা সম্ভব। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এরকম একটি ব্যর্থ দখলের ফলশ্রুতিতে আফগান রাষ্ট্রটি আজ একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আফগান নাগরিকদের জীবন মৌলবাদের কাছে আজ বন্দী।
যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পিছনে আরও কারণ ছিল। সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা চরমে পৌঁছেছিল। অর্থনৈতিক সংকট ছিল তীব্র। বেকারত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে ছিল। সামরিক প্রযুক্তি ছাড়া গণমানুষের ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির তেমন কোনো বিকাশ ঘটেনি। কেবলমাত্র পার্টির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল। ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সোভিয়েত কাঠামোতে গর্বাচেভ ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার হাত দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সম্পন্ন হয়। সেই সময়ে তার কিছু ঐতিহাসিক তত্ত্ব পৃথিবীর সামনে উপস্থিত হয়, যার প্রধান দুটি হলো; গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রইকা।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পরে বরিস ইয়েলৎসিন সরকার জনগণের কাছে আস্থা অর্জন করতে পারেন নাই। বরিস ইয়েলৎসিন মূলত ব্যক্তিজীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। পরিণতিতে পুতিনের ক্ষমতায়নের রাস্তা পরিষ্কার হয়। সেই কারণে জনগণ প্রথমদিকে রুশ জাতীয়তাবাদী চিন্তার সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তোলে। অতীতের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিকতাবাদী চিন্তা পরিত্যাগ করেন পুতিন। নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয় তার নেতৃত্বে। রাশিয়ার জনমানুষকে জাতীয়তাবাদী ধারণায় নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করে আজকের রাশিয়া প্রায় ৮০ /৯০ শতাংশ মানুষ এই জাতীয়তাবাদী চেতনা দ্বারা আবদ্ধ। মধ্যবয়স্ক যাদের বয়স এখন ৬০ কিংবা ৭০ বছর এরা প্রায় সকলেই অতীতের সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্মরণ করে নতুনভাবে।
যদিও সোভিয়েত রাষ্ট্র ভাঙ্গনের সময়ে এরা সকলেই সোভিয়েত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দলের জন্মের সময়ে জাতীয়তাবাদী চিন্তার কারণেই তারা ভাদিমির পুতিনকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করেছিল। সোভিয়েত আমলের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মচর্চায় নিষেধাজ্ঞা নির্বাসিত হয়েছিল পুতিনের সময়। রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চগুলো পুনরায় চালু করা হয়। এমনকি লেলিনের যুগে রাজতন্ত্রের সর্বশেষ যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল- তাদের দেহবাশেষকে সংগ্রহ করে সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন পুতিন। জাতীয় চেতনার এই সমর্থনের ভেতর থেকে রাশিয়ায় নতুন সংবিধান রচনা করেন তিনি । পরবর্তীকালে পুতিন তার প্রয়োজনে সেই সংবিধানের মৌলিক দিকগুলো সংশোধন করেছেন ।এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের নানান দেশে স্বৈরতন্ত্রের সরকার সমূহ করছে নিয়মিত। কখনো কখনো এই সমস্ত পরিবর্তনের জন্য তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত আদালতেরও আশ্রয় নিচ্ছে।
রাশিয়া সংবিধানে একসময় ছিল দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা যাবে না, যা অনেকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু'বারের বেশি কখনো এক রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না এইরকম বিধান আছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম আর রাখা হয়নি, ফলে ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দায়িত্ব থাকার পরে ২০০৮ সালে তার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদভের কাছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সে অবস্থায় ক্ষমতা ত্যাগ করে পুতিন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং তার অধীনস্ত প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন করেন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত মেদভেদেভ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করলেও প্রকৃত ক্ষমতা থাকে মূলত ভ্লাদিমির পুতিনের হাতে।
২০১২ থেকে নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে পুতিন আস্তে আস্তে তার অবস্থান ও রাশিয়াকে নতুনভাবে জাগ্রত করে। বিশ্ব সমাজে রাশিয়া সোভিয়েত আমলে তার যে সক্ষমতা হারিয়েছিল তার পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় লিপ্ত হয়। দেখা যায় যে পুতিনের নেতৃত্বধীন রাশিয়া বিশ্বের সকল স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন যোগাতে থাকে। এক্ষেত্রে অতীতের সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যে পার্থক্যটা দেখা যায়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নামে পুতুল সরকার স্বৈরতন্ত্রকে তারা সমর্থন যোগাচ্ছে । এ অবস্থা দেখা যায় সিরিয়ার আসাদের পক্ষে, লিবিয়ায় এবং এমনকি সাম্প্রতিক কালের মিয়ানমারের সামরিক শাসনের পক্ষও নিয়েছে পুতিনের সরকার।
বর্তমানে ইউক্রেনে যুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সীমান্তে লাখ লাখ সেনা সমাবেশ করেছে রাশিয়া। যার জন্য ইউরোপের দেশগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এবং গত কয়েক বছরের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে স্ট্যালিনের যুগে প্রবেশ করছে পুতিন। স্ট্যালিনের যুগে গুলাগ বা জোরপূর্বক শ্রম শিবিরের মাধ্যমে যেমন লাখো মানুষকে হত্যা করা হতো, তেমনি রাশিয়াতেও এখন একই ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্ব আশংকা প্রকাশ করছে ।
রাশিয়ার প্রধান বিরোধী দলের নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে কিছুদিন আগে বিষ প্রয়োগে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বার্থে তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়ে জার্মানিতে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তীতে এখন সেই নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে কারাগারে পোরা হয়েছে। বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হবে এই আশঙ্কায় বর্তমানে কারাগারে অনশনরত এই নেতা । গত ১৮ দিন যাবত অনশনরত তিনি, রাশিয়াতে তার কোনো চিকিৎসা হলে তাকে আবার বিশ্ব প্রয়োগ করা হবে, এমন আশঙ্কাও আছে ।
বিশ্ব রাজনীতিতে বিশেষ করে জো বাইডেনের ক্ষমতায়নের ফলে পুতিনবিরোধী একটি অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। অতি-সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের বিরুদ্ধে নতুন এক অবরোধ আরোপ করেছে। একইভাবে রাশিয়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পরস্পর বিরোধী নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু হওয়া যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে পুনরায় স্নায়ুযুদ্ধ পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
এরইমধ্যে রাশিয়া প্রচুর নতুন অস্ত্র সংযোজন করেছে তার সামরিক বাহিনীতে, গত কয়েকদিন আগে তারই কিছু নিদর্শন প্রকাশ করে পুতিন সরকার । তবে এই মুহূর্তে একটি আশঙ্কা সামনে আসছে, হঠাৎ করেই রাশিয়াতে যদি কোন বড় ধরনের পরিবর্তন হয়, সেই বরিস ইয়েলৎসিনদের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো, কিংবা কোনো হঠাৎ পরিবর্তন, তা বিশ্ব রাজনীতির জন্যও এক বিশাল সংকটের ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান বিশ্বায়নের এই যুগে শিল্প-বাণিজ্য সবকিছুই নির্ভরশীল বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার উপর। যদি রাশিয়ার মতো বৃহৎ একটি রাজনৈতিক শক্তির অভ্যন্তরীণ কোনো সংকট সৃষ্টি হয়, তার ফল বিশ্বের সবগুলো দেশের উপরে এসে পড়বে নিঃসন্দেহে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক