পুঁজিবাদ ও প্রকৃতির প্রতিশোধ

জনসংখ্যা বিজ্ঞানের হিসাব মতে খৃস্টপূর্ব ৫০০ শত বছরের পূর্বের জনসংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে ৫০ কোটি । যদিও তা কোনো বাস্তব পরিসংখ্যান থেকে নয়। আধুনিক কালের জনসংখ্যা পরিসংখ্যানের আগে কখনো সঠিক জনসংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। প্রশ্ন হলো, মিসরীয় সভ্যতার ব্যাপকতা কিংবা মহোয়েজোডারও কিংবা মায়া সভ্যতার সময়কালে পৃথিবীর জনসংখ্যা কত ছিল?
খৃস্ট পূর্ব ২-৩ হাজার বছরের আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা কত ছিল তা ধারণা করা সম্ভব ছিল না।
পৃথিবীর সেই খৃস্টপূর্ব কাল থেকে যদি আমরা হিসাব করি, তাহলে মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় শত কোটি। অর্থাৎ মাত্র ২৫২০ বছরে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আমরা যদি আধুনিককালের জনসংখ্যার হিসাব দেখি, তাহলে দেখব মাত্র ৮০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০০ কোটি। কেমন একটা অবিশ্বাস্য সংখ্যা।
তবে আমরা যদি আধুনিককালের জনসংখ্যাকে বিবেচনা করি, তাহলে মাত্র ৮০ বছরে যে এই ৪০০ কোটি বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ১৯৪০ সালে পৃথিবী যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত, তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০ কোটি। ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ছিল ৩৩-৩৪ কোটি (ব্রিটিশ ভারতের জনসংখ্যা গণনা হিসাবে)।
১৯৪০-এর দশকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে খাদ্য সংকট দেখা গেছে। ভারতবর্ষের বাংলায়, চীনের নান অংশে আফ্রিকার দেশগুলোতে ছিল ব্যাপক খ্যাদ্য সংকট। পৃথিবী মাত্র ৩০০ কোটি মানুষের খাদ্য সরবরাহ করতে পারে নাই। এ অবস্থায় পরবর্তী দুই দশক একইভাবে দুর্ভিক্ষার সন্ধান ছিল বিশ্বব্যাপী।
পৃথিবীতে যুদ্ধ বিগ্রহ থামানোর জন্য এবং মানব জাতির মঙ্গলের জন্য নতুন সংস্থা গঠিত হয়, নাম যার 'জাতিসংঘ', বিশ্বের বড় যুদ্ধবাজ মার্কিন মাটিতে। সকল ভূখণ্ড থেকে এই মহতি উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে নানা জাতি। যদিও সংস্থাটি একটি ভূয়া সংঘঠন হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। সংস্থাটির জন্মের পর যুদ্ধ বন্ধের বদলে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। মার্কিনিরা এই তথাকথিত জাতিসংঘের আড়ালে পৃথিবীর অধিকাংশ ভূখণ্ডে যুদ্ধ ছড়িয়েছে।
১৯৬০-এর দশকের শেষার্ধে বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি ও দুর্ভিক্ষার কারণে জাতিসংঘ ও মার্কিনিরা নতুন তত্ত্ব হাজির করল পৃথিবীর সামনে। পৃথিবীর দেশগুলোকে বোঝানো হলো, এত জনসংখ্যা পৃথিবীর পক্ষে ধারণ করা সম্ভব না। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা যাবে না। শুরু হলো বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচী।
সেই শুরু হলো নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে এ হোমোসেপিয়ান্সদের জন্ম। প্রকৃতি ক্ষমতা হারাল। পৃথিবীতে নানা ধরনের ব্যবস্থা চালু করা হলো। সেই সময় নারী ও পুরুষকে স্থায়ী বন্ধ্যা করণের কর্মসূচিতে অংশ নিলে নগদ অর্থ প্রদান করা হতো। ৬০-৭০ দশকে গঠিত হলো পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যখন পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করা হলো, তখন ধর্ম ব্যবসায়ীরা মাঠে নেমেছিল পরিবার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে।পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্ম ব্যবসায়ীরা খ্রিস্টান (ক্যাথেলিক চার্চ), বৌদ্ধ, মুসলিম, এমনকি ভারতীয় সনাতন ধর্ম। এই বিতর্ক জাতিসংঘেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপের অনেক দেশসহ ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিলে কার্যকর করা যায় নাই পরিবার পরিকল্পনা ব্যাবস্থা।
সুযোগ পেয়ে পুঁজিবাদ ব্যাপক বিনিয়োগ করল হাইব্রিড কিংবা উচ্চ ফলনশীল কৃষির গবেষণার দিকে। ৬০-এর দশকে আভির্ভূত ফল প্রথমে ধান গমে উচ্চ ফলনশীলতা। বীজের মালিকানা চলে গেল পুঁজিবাদের কাছে। পুঁজিবাদ তার বিনিয়োগের বহু গুণ মুনাফা পাওয়া শুরু করল। দ্রুত বিকাশ পেল অন্য কৃষিতে। পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রণ পেল হোমোসেপিয়ান্সদের খাদ্যসহ সকল কৃষির। পুঁজিবাদ দেখল, পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর আর নির্ভর করা দরকার নাই। শুরু হলো পৃথিবীর বুকে রাসায়নিক সার প্রয়োগ। আমদানি হলো এই উচ্চ ফলনশীলতার গর্ভ থেকে নানা কীট পতঙ্গের। সাথে সাথে জন্ম নিল রাসায়নিক কীটনাশক বিষাক্ত হয়ে উঠল পৃথিবীর গর্ভ- মাটি ও পানি।
পরবর্তী দশকগুলিতে বিষাক্ত হয়ে গেল নদী, সাগর, মহাসাগর। বিকাশ ঘটল পুঁজিবাদের নতুন মাত্রার। পুঁজিবাদ তার বিকাশের রাস্তাকে আরও মসৃণ করল নতুন নতুন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে। নানাভাবে হোমোসেপিয়ান্সদের বেঁচে থাকার সময়কাল বৃদ্ধি পেল। মানুষের গড় আয়ু ৪০ থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকল প্লেগ কালের গড় আয়ু থেকে। বিকাশ ঘটল পুঁজিবাদের শক্ত ভিত্তির ঔষধ শিল্পের। পুঁজিবাদী দেশগুলি নতুন রোগ রোগ নির্ধারণের সকল যন্ত্র আর ঔষধ সবকিছুর মালিকানা পেল কিংবা অর্জন করল। তাদের একটা ক্লাব হলো; নাম হলো জি-৭। এই জি-৭ পৃথিবীর সকল ক্ষমতা অর্থের মালিক। পুঁজিবাদী দেশগুলোর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে, যে কারণে আরও ক্লাব হয়েছে, নাম তার জি-২০।
মজার বিষয় হলো, বিশ্ব জনসংখ্যা যখন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এই পুঁজিবাদী দেশগুলোর জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। এদের গ্রামীণ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোর সাথে আছে এশিয়ার জাপান, সিংগাপুর, হংকং, তাইওয়ান, এমনকি নব্য পুঁজিবাদী দেশ চীনও। সাথে আছে আটলান্টিকের ওপারের অনেক দেশ।
৬০-৭০ দশকের ব্যাপক দুর্ভিক্ষে চীনের এক কোটি মানুষ জীবন হারিয়েছিল ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে। মাও সেতুংয়ের চীন ব্যর্থ হয়েছিল সেই দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পেতে। খ্যাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি তখনও সম্ভব হয় নাই। যে কারণে চীন তখন দ্রুত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের রাস্তায় হাঁটে আর দেশের এক সংখ্যার অধিক সন্তান গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই সময় চীনের জনসংখ্যা ছিল ৭০ কোটি। যে নিষেধাজ্ঞা চীনের অনেক সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি করেছে। দেশটিতে নারী পুরুষের আনুপাতিক হারের ব্যাপক পার্থক্যের সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের এই এক সন্তান নীতি সম্প্রতি পরিত্যক্ত হয়েছে, যখন চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৪৫ কোটিতে পৌঁছেছে। প্রশ্ন এখানেই, চীন কেন করল এ কাজ?
গত শতাব্দীর শেষ দশকে চীন তার সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে মুক্ত বাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। চীন দ্রুত অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে। চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য্য চীনকে পুঁজিবাদের সমস্ত রাস্তা অনুসরণ করতে উদ্ভুদ্ধ করে।
পুঁজিবাদের প্রথম সাফল্য আসে তার উৎপাদিত বাজার। পণ্য ও ক্রেতা। বিগত শতাব্দীর শেষ ভাগে পুঁজিবাদ বুঝতে পারে, পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি না হলে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজার পাবে না। নতুন পণ্যের ক্রেতা খোঁজার প্রয়োজনীয়তা যেন না হয়, সেই কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হলো পুঁজিবাদ। ইউএস-এইড তাদের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসুচিতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিল। সাথে থাকল ধর্ম ব্যবসায়ীরা।
অনুন্নত বিশ্বের জনসংখ্যা দ্বিগুণ-তিন গুণ বৃদ্ধি পেল দ্রুত। এই বাড়তি জনসংখ্যা প্রথমত পুঁজিবাদের ক্রেতা আর দ্বিতীয়ত সস্তা শ্রমিক সৃষ্টিতে সহায়তা করল পুঁজিবাদের প্রয়োজনে।নতুন দাস ব্যবস্থার প্রবর্তন হলো। অধিক জনসংখ্যার দেশে পরিণত হলো কিছু দেশ। এশিয়ার ভারতবর্ষের তিনটি দেশসহ আফ্রিকার বহু দেশ।
সমস্যা সৃষ্টি হলো সেই জি-৭ আর জি-২০ দেশগুলোর। গত শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই শুরু হয়েছিল নারীদের নানা অধিকার আদায়ের আন্দোলন; ইউরোপের ব্রিটেনের নারীরা তাদের ভোটের অধিকার অর্জন করে চূড়ান্তভাবে ১৯২৮ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা এশিয়ার জাপান আরও পরে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৯৪৬ সালে নারীর ভোটের অধিকার প্রদান করে।
মজার ব্যাপার, ১৯৬৪ সালে সংবিধানের ২৪তম সংশোধনীর আগ পর্যন্ত আমেরিকার নারী ভোটারদের পোল ট্যাক্স আর শিক্ষা প্রমাণের সনদ দেখাতে হত; যার ফলে কালো আর দরিদ্র সাদা নারীরা ভোটার হতে পারত না। ২৪তম সংশোধনী, দুই-তৃতীয় ভাগ রাজ্য সেই সংশোধনী পাশ করার পর সকল নারীরা তাদের ভোটের অধিকার পায়।
জি-৭ কিংবা জি-২০ দেশগুলোতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর নারীরা শিক্ষা এবং বাহ্যিক কর্মজীবনে ব্যাপকভাবে প্রবেশ করল; ফলে নারীরা সন্তান ধারণ কমিয়ে দিল। পরিণতিতে ওই দেশগুলোর জনসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকল ব্যাপকভাবে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে বৃদ্ধ মানুষের দেশে পরিণত হলো বহু ইউরোপিয় দেশ সহ এশিয়ার জাপান ও কয়েকটি দেশ। শুরু হলো নতুন দাস ব্যবস্থার। তৃতীয় বিশ্বের জনবহুল দেশ থেকে কর্মহীন মানুষদের প্রায় বিনা মজুরিতে ভাড়া করা আর এই দেশগুলো যখন নিজ সম্পদ ব্যয় করে কিছু ডাক্তার প্রকৌশলী তৈরি করে তখন তাদের বিত্তের লোভ দেখিয়ে নিজ দেশ ত্যাগে বাধ্য করে- যার নাম ইমিগ্রেশন।
পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটল বিভন্নভাবে; তার মধ্যে অন্যতম ছিল মুদ্রা ব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান শক্তি আমেরিকা পারমাণবিক বোমা আক্রমণ চালিয়ে পৃথিবীর কাছে পরমশক্তিশালী প্রমাণ করেছে নিজেকে। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রীর সহয়তায় মার্কিন ডলারের বিশ্ব বাণিজ্যিক মুদ্রার ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব গৃহিত হয় পৃথিবীর ৭৭টি দেশে। ডলারের এই স্বীকৃতি আমেরিকার বিশ্ব জয়কে সহয়তা করে। গঠিত হয় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক; কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জাপান আমেরিকার এই প্রস্তাব গ্রহণ না করে নিজ মুদ্রায় বাণিজ্য বজায় রাখে। আমেরিকার সুযোগ হয়ে যায় পৃথিবীর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে। শুরু হয় আমেরিকার বাণিজ্য অবরোধ। কতখানি হিংস্র এই মার্কিন রাষ্ট্র পৃথিবীর এই সংকটকালে বহাল রেখেছে অবরোধ ইরান, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলার ওপর । পৃথিবীর দেশগুলোর ভুল হয়েছিল ডলারকে বিশ্ব বাণিজ্য মুদ্রা বানানো।
এ সবই ছিল পুঁজিবাদ বিকাশের ইতিহাস। পুজিঁবাদ তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। এখন তার পতন এর সময়। কোভিড-১৯ তার আগমন বার্তা। পুঁজিবাদের কাছে ধর্ষিত পৃথিবী তার প্রতি আক্রমণ শুরু করেছে। করোনাভাইরাস প্রকৃতির হাতিয়ার। হিংস্র পুঁজিবাদকে ধ্বংস করতে হলে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে ৩০০ কোটি মানুষকে। তাহলে পৃথিবী ফিরে পাবে তার প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রয়োজন হবে না অধিক ফলনশীল কৃষির। বন্ধ হবে পৃথিবীর বুক চিড়ে তেল গ্যাস উত্তোলনের। পৃথিবীর মাটি পরিশোধিত হবে। রক্ষা পাবে পৃথিবীর পচনশীল মাটির দেহ। বেঁচে যাবে পৃথিবীর নদী, সাগর, মহাসাগর।