পশ্চিম বাংলার নারোদকাণ্ডে অভিযুক্তদের জামিন ও উপমহাদেশে দল নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা
ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সামগ্রিক অবস্থার আরও একটি অধ্যায় উম্মোচিত হলো। পশ্চিম বাংলার নারদ মামলা নিয়ে সিবিআই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার পরিণতিতে এই অধ্যায় রচিত হলো। একইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এই মামলা সিবিআই কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টে স্থানান্তর করার চেষ্টার তীব্র সমালোচনা করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট সমালোচনা করেছেন সিবিআইয়ের এই মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিদেরকে গ্রেপ্তার করারও। এতে এর অর্থ দাঁড়ায়, সুপ্রিমকোর্ট পশ্চিম বাংলার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কর্তৃক পরিচালিত বিচারিক সিদ্ধান্তগুলো মেনে নিতে পারছেন না। মধ্যরাতে কোর্ট বসিয়ে আদালত কর্তৃক জামিন স্থগিতাদেশ দেওয়াটাও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছেন।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সিবিআই রাজ্য দপ্তরে ধর্ণা দেওয়ার বিষয় ও পশ্চিম বাংলা রাজ্য আইনমন্ত্রীর জামিন শুনানির জন্য আদালতে উপস্থিত হওয়ার ঘটনা। পশ্চিমবাংলাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে ভারতীয় সমাজের বিচার বিভাগের স্থূল চেহারা এভাবেই মূলত বেরিয়ে এসেছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশ ব্রিটিশ উত্তরাধিকার আইন দ্বারা পরিচালিত। তিনটি দেশ আলাদা আলাদাভাবে বিচার বিভাগ পরিচালনা করছে। একদিকে যেমন মূল বিচারব্যবস্থায় ব্রিটিশ আইনগুলো রক্ষা করে চলছে, তেমনি বেশ কিছু আলাদা অবস্থানও গ্রহণ করেছেন।
প্রথমে আসা যাক পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থায়। পাকিস্তান সাধারণ বিচারের সাথে আবার ফেডারেল শরিয়া আদালত স্থাপন করেছে, যা পাকিস্তানের মুসলিম মৌলবাদীদের দাবির কাছে নতি স্বীকার। এর পরিণাম সাধারণ আইনের সাথে এই ফেডারেল শরিয়া আইনের অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরোধী অবস্থান।
আদিকালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আইনে যেমন চুরির অপরাধে ব্রিটেনে মৃত্যুদণ্ড চালু ছিল। তেমন কিছু ধারা এখানেও সংযুক্ত আছে। শরিয়া আইনের দুর্বল দিক হচ্ছে, স্বল্পমাত্রার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা। পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্বাহী কর্তৃত্ব বিচারিক আদালতের উপর প্রতিষ্ঠিত। জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসিসহ আরও বহু মামলার নিদের্শনাই হচ্ছে বিচার আদালতের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ। এর ফলাফল, সাত চল্লিশে ভারত-পাকিস্তান জন্মের সময় ভারত বিচারব্যবস্থায় তার ব্রিটিশ আইনের উত্তরাধিকারিত্ব গ্রহণ করে ঠিকই; কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই তারা তাদের নিজেদের অবস্থানকেও সংশোধন করেছে।
ভারতে অতীতেও বিচার আদালতের বলিষ্ঠ ভূমিকা দেখা গেছে। যদিও তা ক্রমান্বয়ে বিলীন হতে চলছে বলেও ভারতীয় সমাজে এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে।
ভারতীয় বিচারব্যবস্থার কারণেই ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৭৫ সালের জুনে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল। নির্বাচনী এলাকায় একজন সরকারী কর্মকর্তাকে পোলিং এজেন্ট নিয়োগ সংক্রান্ত বির্তকের প্রেক্ষিতে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। সেই রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিলেও বহাল থাকে, যার পরিণতিতে চূড়ান্তভাবে ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সংবিধান স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল।
ভারতের রাজ্য হাইকোর্টগুলো রাজ্যের নিম্ন আদালতের সকল বিষয় দেখভাল করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নাই বললেই চলে।
একাত্তরে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জন্ম নিলেও বিচার আদালত স্বাধীন হয়নি। বিচার আদালতের নিয়ন্ত্রণ এখনো নির্বাহী বিভাগের হাতে। যদিও বিচার আদালতের পদোন্নতি এবং বদলির ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের 'মতামত' গ্রহণ করার বিধান থাকলেও সংবিধানের যে মৌলিক ধারণা, সেখানে বিচার বিভাগের অধীনস্থ আদালতের সকল দায়-দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের উপরই ন্যস্ত থাকার কথা, সে দিক থেকে এখনো কাজটি সম্পন্ন হয়নি বলে বলা যেতে পারে।
আমাদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের আইন আমাদের পার্লামেন্ট নির্ধারণ করতে পারে নাই। উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের সুনির্দিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ২০১০ সালে 'জনস্বার্থে' (পিআইএল) রিট আবেদন করা হয়। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সেই রিটের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি নিয়োগে একটি আইনের রায়ও ঘোষণা করেন। কিন্তু বিচার আদালতের নিয়ন্ত্রণ এখনো নির্বাহী বিভাগের হাতেই আছে।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট কখনো কখনো জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এখানে দুটি বিপরীত ঘটনা ঘটনা উল্লেখ করা যায়। একটি হলো, পশ্চিম বাংলার সিবিআই কর্তৃক মামলা সুপ্রিম কোর্টের স্থানান্তরিত করার আবেদন সরাসরি নাকচ করে দেওয়া। কিন্তু দ্বিতীয়টি জনগণের স্বার্থ পরিপন্থী। এতে ভারতীয় নির্বাহী বিভাগ হোয়াটসঅ্যাপ নামে খ্যাত অ্যাপসটিকে তাদের তথ্য সরবরাহের নির্দেশ প্রদান করে একটি গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছে। এই গাইডলাইনের পরিণতি হচ্ছে, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ করা। যদিও ভারতীয় আইনমন্ত্রী বলছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই চূড়ান্ত। কিন্তু তিনি আবার এ কথা বলছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, ভারতীয় স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করাকেও 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতা' হিসেবে মানতে হবে। কিন্তু এটি পুরোই চিরায়িত ভাষা, এই ভাষা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। এই অবস্থান চিরকালই বিভিন্ন দেশে টিকে আছে।
সরকারের বিরুদ্ধে জনগনের গোপনীয়তার অধিকার হরণের অভিযোগ তুলে মামলা করেছে হোয়াটসঅ্যাপ। আদালত মামলাটি গ্রহণ করেছেন।
মামলা করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সর্বশেষ সংস্কারের আরেকটি উদাহরণ দেখতে পাই ৬ জানুয়ারি ২০২১ ট্রাম্প অনুসারীরা যখন মার্কিন কংগ্রেস ভবন আক্রমণ করে, তখন অভিযোগ উত্থাপিত হয়, কংগ্রেস ভবন আক্রমণ করার জন্য ট্রাম্প তার অনুসারীদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। কিন্তু মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং সমাজের নানা স্তরের মানুষ এক্ষেত্রে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুপ্রেরণায় যারা ওই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, 'দোষী' তারাই। কারণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জায়গা থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যা কিছু বলুন না কেন, তার দায়ভার যিনি 'বলেছেন বা উসকানি' দিয়েছেন তার নয়। 'আপরাধ' সংঘটিত হয়েছে পার্লামেন্ট ভবন ভাংচুরের মাধ্যমে। 'দায়ী' যারা ভাঙচুর করেছে তারা, ডোনাল্ড ট্রাম্প নন।
আমাদের দেশের আইনে, 'হুকুমদাতা' বা 'উসকানিদাতা' হিসেবে ট্রাম্প দায়ী। আমাদের প্রচলিত আইনে হুকুমদাতাই প্রধান অপরাধী। 'হুকুমের আসামি' আমাদের বিচার অঙ্গনের বহুল ব্যবহৃত শব্দ।
আজ বৃহস্পতিবার অল্প কিছু সময় পরেই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্টে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চেই চার হেভিওয়েট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জামিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। সুপ্রিম কোর্টের আলোচনায় এই জামিন প্রাপ্তি যে অগ্রগণ্য, তা স্পষ্ট হয়েছে। তারপরও দেখা যাক, পশ্চিম বাংলা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বের আদালত কি রায় প্রদান করেন। কারণ, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির জম্মু-কাশ্মীরের ভারপ্রাপ্ত বিচারপতি থাকার সময় মানুষের মৌলিক অধিকার, জামিনের আবেদন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। জামিন বঞ্চিত করেছেন কাশ্মীরে বহু রাজনৈতিক নেতাকে, যারা মূলত কাশ্মীরের ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণার বিপক্ষে আন্দোলনে ও সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন।
আজ স্পষ্ট হবে পশ্চিম বাংলার হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায় আছে কিনা।
-
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক