পশ্চিমবাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি’র অব্যাহত চেষ্টা
পশ্চিমবাংলার মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলো, রাজ্য ও কেন্দ্রের সংঘাতের এক নতুন মাত্রা। নির্বাচনের ফল প্রকাশের মাত্র ১৫ দিনের মাথায় পশ্চিম বাংলার দু'জন মন্ত্রীসহ অপর দুই জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের সিবিআই তাদের রাজ্য সদরদপ্তর নিজাম প্যালেসে নিয়ে যায়। অভিযোগ ২০১৪ সনের। এই অভিযোগে আরো দুজন ব্যক্তির নাম প্রথম সারিতেই ছিল। যার অন্যতম হচ্ছে শুভেন্দু অধিকারী ও মুকুল বোস। অভিযোগের নাম নারোদা কান্ড।
দক্ষিণ ভারতের একজন সাংবাদিক ম্যাথু স্যামুয়েল ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এক স্ট্রিং অপারেশন চালিয়ে মুকুল বোস, শুভেন্দু অধিকারী এবং আজকের গ্রেফতারের সবাইকেই অর্থায়ন করেছিল। গোপন ক্যামেরায় অর্থ লেনদেনের দৃশ্য ধারণ করে প্রকাশ করে দিয়েছিল। মমতা ব্যানার্জি তখন এই ঘটনাকে পাতানো এবং সাজানো ঘটনা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ, ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে নির্বাচনে এই অভিযুক্তরা প্রায় সকলেই নির্বাচনে জয়লাভ করে ফিরে এসেছিল। মমতা ব্যানার্জির শপথ নেওয়ার সময় থেকেই পশ্চিম বাংলার রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছিল। পশ্চিমবাংলার রাজনীতির ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায়। রাজ্যপাল সরাসরি পশ্চিমবাংলায় সরকার বিরোধী একটি অবস্থান গ্রহণ করেছেন যা তিনি নির্বাচনের আগেও বহুবার প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন। এই দলবাজ রাজ্যপাল তাঁর নিরপেক্ষতা বহুবার ভঙ্গ করেছেন বলে, পশ্চিমবাংলার তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি অভিযোগ করেছেন।
পশ্চিমবাংলা সরকারের প্রতি কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা স্পষ্ট। পশ্চিমবাংলার নির্বাচনের আগে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমবাংলার আকাশ মাটি দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা সৃষ্টি করার মতন অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে। উত্তর ভারতের বিখ্যাত যোগী আদিত্যনাথ একই ভাষায় কথা বলেছেন। তারপরে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে পদত্যাগকারী শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগদান করে একই ভাষায় কথা বলেছেন। আশঙ্কা হচ্ছিল যে, পশ্চিমবাংলার নির্বাচনী ফলাফল যদি বিজেপির অনুকূলে যায় তাহলে বিষয়টি কোনদিকে যাবে। বিজেপি'র পরাজয় ঘটেছে বিধানসভা নির্বাচনের সংখ্যায়। পশ্চিমবাংলা বিধানসভা আসনের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও পশ্চিমবাংলার ভোট প্রাপ্তিতে বিজেপি এক বিশাল চমক সৃষ্টি করেছে। মাত্র ৯% ভোটের ব্যবধান তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি'র। পশ্চিমবাংলা রাজ্য নির্বাচনের পরে আরও কয়েক জায়গায় বিজেপি ধরাশায়ী হয়েছে।
দু'জন রাজ্য পর্যায়ের মন্ত্রীকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আজ উত্তপ্ত। গ্রেফতারের সংবাদ গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কিছু পরেই সেই বিখ্যাত নিজাম প্যালেসে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী তার বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে ধরনায় বসেছেন। এই অন্যায় গ্রেফতারের প্রতিবাদে তিনি ধরনায় বসেছেন। বিষয়টি স্বাভাবিক প্রটোকল বিরোধী। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী যে অবস্থান নিয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গ মানুষের কাছে একটা নতুন বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে কি পশ্চিমবাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন আসন্ন?
ইতিমধ্যে বিজেপি'র স্থানীয় নেতৃত্ব পশ্চিমবাংলা রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তুলছে। যদিও ভারতীয় সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি শাসন ৬ মাসের অধিককাল দীর্ঘায়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। ৬ মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসন প্রতিষ্ঠা করে বিজেপি ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে কতটুকু অগ্রসর হতে পারবে সেটিও একটি বিবেচ্য বিষয়।
ধর্মতত্ত্ব দ্বারা ভারতীয় সমাজ আদিকাল থেকে বিভাজিত। পশ্চিমবাংলার এবারকার নির্বাচন তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এ রাজ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি হওয়াতে তৃণমূল কংগ্রেস মূলত মুসলিম ভোটকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। আর এর বিপক্ষে হিন্দু ভোটকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে বিজেপি। সেদিক থেকে তৃণমূল কংগ্রেস যথেষ্ট সার্থকতা লাভ করেছে। ভোটের হিসাবে দেখা গেছে, মুসলমানদের ভোট মূলত তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে গেছে।
বিজেপি পশ্চিমবাংলায় কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো সিবিআইকে দিয়ে নারোদা কান্ডের অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে। অভিযোগপত্র থেকে শুভেন্দু অধিকারীর নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সাথে মুকুল বোসের নামও এই অভিযোগ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ দায়ের করা সাংবাদিক ম্যাথু স্যামুয়েল পরিষ্কার ভাষায় জানতে চেয়েছেন, শুভেন্দু অধিকারী ও মুকুল বোসের নাম কেন বাদ দেয়া হয়েছে, তাদেরও গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত বলে দাবি করেছেন তিনি।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির মূলে ছিল ধর্মীয় বিভাজন। চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে ভারতবর্ষের মানুষ জানত না যে, ভারতের স্বাধীনতা মানেই দেশটি দ্বিখণ্ডিত হবে। চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে ভারত বিভক্তির অবস্থার সৃষ্টি হতে থাকে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুসারে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মুসলিম লীগ কর্তৃক গ্রহণ এবং প্রত্যাখ্যান, কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি নানান ঘটনার পরিণতিতে সৃষ্টি হয়েছিল ভারত বিভক্তি। ধর্মের ভিত্তিতে সেই বিভক্ত ভারতকে আজকের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। ভারত চতুর্দিকের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে এক ধরনের শত্রুতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। '৪৭ থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে, ষাটের দশক থেকে চীনের সঙ্গে এমন কি হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের সঙ্গে তার সম্পর্ক শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। আর এই অবস্থায় ভারত তার সামরিক ব্যয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। এবারের রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের সামরিক ব্যয় আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে গত ২০২০ সালে।
ভারতের রাজনীতিতে শাসকচক্র অব্যাহতভাবে ধর্মীয় বিভাজনকে ব্যবহার করছে। এই ধর্মীয় রাজনীতির বিজয় সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে পশ্চিমবাংলায় খুব দ্রুত রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলে আমরা বিস্ময় প্রকাশ করব না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক