নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য আরেকটা সরকারব্যবস্থা দিলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয় না
২০২৩ সালে আমাদের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বড় দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বহুকালের পুরনো বিতর্ক নতুন আঙ্গিকে আবার সামনে চলে আসছে। কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালিত হবে?
এই বিতর্কের মধ্যেই বাংলাদেশের দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার বিতর্কের মধ্যেও নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়েছে।
২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় প্রদান করেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেওয়া হয়। সরকারের হাতে এই আইনি ম্যান্ডেট থাকার ফলে প্রধান বিরোধীদলের- যারা ইতিপূর্বে একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল- ২০১৪ নির্বাচন বর্জন এবং নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক সহিংসতার পরও নির্বাচন করা ও সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছিল।
পত্রিকায় জানা গেছে, গতকাল (১৫ সেপ্টেম্বর) দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল উচ্চ পর্যায়ের মিটিংয়ে আবারও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার দাবি জানানো হয়েছে। গত ১০ বছরের অধিককাল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এই বির্তকে আবর্তিত। এই বির্তক বহুকালের ও এক সময় বর্তমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলটি এই দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছিল। ১৯৯৩-১৯৯৬ সালের পর আবার এই দলই এ ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
কেবলমাত্র নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা যে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করে না, তা আমরা অতীতে জানতে শিখেছি। সেই কারণে মনোযোগ দিতে হবে অন্যত্র। আগামী ফেব্রুয়ারিতে এই নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। ২০২৩-এর জাতীয় নির্বাচন নতুন কমিশন পরিচালনা করবে। মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ ইতোমধ্যে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে নির্দেশনা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী নিয়োগ প্রদান করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ভিত্তি কী হবে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ কোথাও নেই।
বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে আমরা অনেক ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেখেছি। প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছার প্রতিফলন 'আজিজ কমিশন' আমরা দেখেছি। অভিজ্ঞতা ভালো না। ভালো বিকল্প হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে কমিশন গঠন করা। রাজনৈতিকভাবে চূড়ান্ত বিভক্ত সমাজে কীভাবে সেই ঐকমত্য তৈরি হতে পারে, সে এক বিরাট প্রশ্ন।
আমরা সার্চ কমিটির চর্চা দেখছি গত দুই মেয়াদে। সার্চ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। আবার সার্চ কমিটি যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের উপায় খুঁজতে থাকে, তখন দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় নিজ দলের কয়জনকে কমিশনে যুক্ত করা যায়, সেটি। ফলে নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের চেষ্টা আর শেষমেশ থাকে না। কমিশন গঠিত হওয়ার পর কমিশনারগণ কে কোন দলের, তা সহজে বলে দেওয়া যায়।
একটা মানুষ নিয়োগ পাবেন দলীয় বিবেচনায় আর আমরা স্বপ্ন দেখতে থাকি একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের! আমাদের রাজনৈতিক চিন্তার বৈপরীত্য এখানে। সে কারণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন শক্ত ভিত্তি পায় না।
এখানে দুই ধরনের প্রবণতার আশঙ্কা থেকে যায়। দলীয় বিবেচনায় মনোনীত হওয়া মানে প্রথমেই নিজের নিরপেক্ষতা হারানো। অন্যটি আরও ভয়ঙ্কর, সার্চ কমিটির মাধ্যমে এমন কেউ মনোনীত হয়ে এলেন যিনি তার কর্মজীবনের কোনো পর্যায়ে কোনো দল বা দলীয় সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে সংক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন বা বঞ্চিত হয়েছিলেন, এমনটি যদি মনে করে থাকেন, তাহলে ঐ ব্যক্তির পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন সম্ভব নয়। যে উদাহরণ বর্তমান কমিশনের অনেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তারপরও সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠন প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছার তুলনায় মন্দের ভালো বলে অনেকে মনে করেন।
আমাদের পাশের দেশ ভারতেও সরকারের সুপারিশে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা একেবারে ত্রুটিমুক্ত না হলেও সেটির প্রতি মানুষের আস্থা রয়েছে। কিন্তু আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাগ্রহ ও অনাস্থা মারাত্মক সীমায় পৌঁছেছে। সমগ্র ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন দরকার। কোনো রাজনৈতিক দল সেটা নিয়ে কথা বলছে না। মানুষ যেভাবে নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তাতে সরকারও স্বস্তিতে নেই, সেটা বোঝা যায়। এত অল্প সংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হলে আইন দ্বারা সিদ্ধ হলেও নৈতিকতার প্রশ্নে আটকে যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
আমাদের সংবিধানে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য আইন তৈরির কথা বলা থাকলেও কখনোই কোনো দল বা সরকার এই আইন তৈরির কথা ভাবেনি। আলোচনাতেও আনেনি। এমন কি বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় আইন তৈরির নিদের্শনা সংবিধানে থাকলেও তা উপেক্ষিত থেকেছে। আমাদের দেশের সিভিল সমাজ কখনো কখনো এই আইন তৈরির প্রসঙ্গ তুললেও তা প্রতিশ্রুতির মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটি প্রায় একযুগ টানা ক্ষমতার বাইরে। সেখানেও কোনো নুতন চিন্তা নেই।
বাংলাদেশের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন কীভাবে সম্ভব, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। সংবিধানের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী বিচারপতি থেকে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত পদগুলো সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা নিয়োগ ও অপসারণের ব্যবস্থা থাকলে তখন হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি নিয়ে এত হৈ চৈ করতে হতো না।
একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন অবশ্যই একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অন্যতম শর্ত। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী কমিশন নিয়োগের জন্য যেমন আইন থাকতে হবে, তেমনি কমিশন কীভাবে স্বাধীন হতে পারে, তা নিয়েও ভাবতে হবে। কমিশনের অর্থ ও লোকবল নেই। এ দুটোর জন্য কমিশন সরকারের প্রতি নির্ভরশীল। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালে আমলাতন্ত্র নির্বাচন কমিশনের আওতায় তাদের চাকরি ন্যস্ত থাকে। সে অনুযায়ী নির্বাচনকালীন মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনের সকল দায়িত্ব জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে গ্রাম পুলিশ পর্যন্ত সবাই সরাসরি যুক্ত থাকেন। নির্বাচনে পর এরা আবার প্রশাসনের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের আওতায় চলে যান। নির্বাহী বিভাগ দলীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হলে প্রশাসনের ঐ ব্যক্তিরা নির্বাচনে কীভাবে 'নিরপেক্ষ' দায়িত্ব পালন করলেন? এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা জরুরি।
এখন সারা বছর আমাদের কোনো না কোনো পর্যায়ের নির্বাচন চলতে থাকে। প্রতিবার নির্বাচন কমিশনকে প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যাহত হয়। ভাবতে হবে কমিশনের কাঠামো নিয়ে। নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে সকল কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ও স্থায়ী লোকবল দিয়ে করতে হবে। যারা একটি আইন দ্বারা গঠিত স্বাধীন কমিশনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চাকরি করবেন। আমাদের জাতীয় নির্বাচনও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের মতো কয়েক ভাগে করা যেতে পারে। জাতীয় বাজেট প্রণয়নের সময় নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ সুনির্দিষ্ট করে এই তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কমিশনের কাছে ন্যস্ত করতে পারলে 'স্বাধীন ও নিরপেক্ষ' নির্বাচন কমিশন কথাটি অর্থপূর্ণ হবে।
দেশে পক্ষপাতিত্ববিহীন নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোথাও অনুশীলন হতে দেখা যায় না। এই মডেল কম-বেশি আমাদের দেশেই অনুশীলন করা হয়েছে। যতটুকু অনুশীলন হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে এই ব্যবস্থা একেবারে নিচ্ছিদ্র ও পরিচ্ছন্ন, সে কথা বলা যাবে না।
'৯১-এর নির্বাচনেও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে 'সূক্ষ্ম কারচুপি'র অভিযোগ উঠেছিল। ১৯৯০ পর্যন্ত নামে বেনামে সামরিকতন্ত্র চালু থাকায় দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। এই যুক্তিতে '৯১-এর সরকারের কাছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি উঠতে থাকে। জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ ও নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত করার জন্য সেই সময়ের বিরোধী দল ১৯৯৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিল সংসদ সচিবালয়ে পেশ করে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা প্রথম থেকেই এ দাবি অসাংবিধানিক বলে অগ্রাহ্য করতে থাকে।
১৯৯৪ সালের সংসদীয় আসনের একটি উপ নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে অনাস্থার ধারণাটি প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে বিরোধীদের দাবি জোরাল হতে থাকে। বিরোধীদের দাবি নাকচ করে দিয়ে সেই সময়ের সরকার প্রধান বলেন, 'একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।'
১৯৯৬ সালে সংবিধান সম্মতভাবে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে ১৯৯১-এর নির্বাচন হলেও তখন পর্যন্ত এই ধরনের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
১৯৯৬-এর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা ১১৬ আসন নিয়ে বিরোধী আসনে বসেন। তৃতীয় আর একটি দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠিত হয়। রাজনৈতিক ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বিভেদ চরম আকার ধারণ করে। সংসদের কোনো অধিবেশন সুষ্ঠুভাবে চলতে পারেনি।
২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সময়ে 'প্রশাসন দলীয় প্রভাবমুক্ত' করার লক্ষ্যে বড় দলগুলো নিজেদের পছন্দের আমলাদের তালিকা নিয়ে ছুটাছুটি করতে দেখা যায়। কোন দল কোন আমলাকে কোথায় বসাতে পারবে, সে এক নিদারুণ প্রতিযোগিতা! নির্বাচনে এখানেও ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। নির্বাচনী সহিংসতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অনেক জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয়।
নির্বাচন থেকে জনগণ কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তা নিয়ে কখনোই বিশ্লেষণ হতে দেখি না। দায় কেবল জনগণের না রাজনৈতিক দলের- তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এখন আর জনগণের সমর্থনের ওপর নির্ভর না করে বরং প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা গ্রহণকেই মুখ্য উপায় বলে মনে করে। এই সর্বনাশা প্রবণতা ঠিক কখন থেকে শুরু, তা বলা না গেলেও কিছু অনুমান সামনে চলে আসে: ক্ষমতাসীনরা মেয়াদ শেষের আগে ভাবতে থাকে, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হচ্ছেন? সেদিকেই সবার মনোযোগ নিবদ্ধ হয়, যেন প্রধান উপদেষ্টাই পছন্দের দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবেন। 'জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস'- এ বাণী ক্রমান্বয়ে উপেক্ষিত হতে থাকে। ক্ষমতাসীনরা হিসেব করে দেখে, বর্তমান প্রধান বিচাপতি পরবর্তী নির্বাচনের আগেই অবসরে চলে যাবেন। পরবর্তী যিনি আসবেন, তার ওপর ভরসা কম। সে কারণে ২০০৪ সালের ১৬ মে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস করা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় পরের দিন, ১৭ মে।
বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমার বৃদ্ধির বিষয়টি বিরোধীরা ক্ষমতাসীনদের 'দুরভিসন্ধি' হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে ক্ষমতাসীনরা বিচারপতিদের অবসরের বয়স বৃদ্ধির 'সুফল' ভোগ করতে না পারলেও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটিকে বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত 'অন্য ধরনের' তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়। সম্মুখে বেসামরিক, কিন্তু অন্তরালে সামরিক- এ রকম এক অদ্ভুত শাসন ব্যবস্থা বহাল থাকে দুই বছর।
এত কিছুর পর যখন দেখি একটি রাজনৈতিক দল কোনো রূপরেখা ও সংস্কার কর্মসূচী ছাড়াই কেবল নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের কথা বলে, তখন জনগণ হতাশ হয়। পরিবর্তন তো আকাশ থেকে আসবে না। রূপরেখা দিতে হবে। তর্ক- বিতর্ক হবে রূপরেখা নিয়ে। তা না হলে একই তিমিরে থেকে যাবে দেশ।
নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য একটি সক্ষম নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো একেবারেই প্রাথমিক কাজ। আমাদের দেশের নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য এখনো নির্বাহী বিভাগের ওপরই নির্ভরশীল। জেলা পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গঠিত হলেও নির্বাচন পরিচালনার জনবল এখনো সেভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। ফলে নির্বাচনের দিনে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মানুষজনকে জড়ো করতে হয় নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য। এই নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের জনগণ প্রকারান্তে সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সে কারণে কেবলমাত্র নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটি সরকারব্যবস্থার পাল্টা দিলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
নির্বাচনকালীন সময়ে সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করলেই একটি সক্ষম নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা থাকে। সেদিকটা সংস্কারের একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত, যেন নির্বাচন পরিচালনা করার সময় অন্য কোনো প্রশাসনিক পদে নিয়োগ কিংবা কর্মীদেরকে নিয়োগ করতে না হয়।
দেশে এখন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়; সে কারণে এই ধরনের জনবল সৃষ্টি করা কোনো অপব্যয়ও নয়।
-
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক