নন্দীগ্রামের নির্বাচন কি ভারতের গণতন্ত্রের দুর্বলতা উন্মোচন করবে!
পহেলা এপ্রিল ভারতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে নন্দীগ্রামসহ দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬০টি আসনে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের দিন কী ঘটবে এই নিয়ে যে আশঙ্কাগুলো করা হয়েছিল, তার অনেকটাই বাস্তব চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে। আর ডেমোক্রেটিক ইনডেক্সে ভারত যে কিছুটা পিছিয়ে গেছে, তারই প্রমাণ ওই নির্বাচন।
পশ্চিমবাংলার নির্বাচন নিয়ে গত শুক্রবার মিডিয়া যেসব বিষয়কে সামনে তুলে ধরেছে, তাতে ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। নির্বাচন ব্যবস্থায় সরাসরি ভারতের কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কারণ তৃণমূল কংগ্রেসের এজেন্ট দেওয়া-নেওয়া এটা পুরো তাদের বিষয়, এখানেও কেন্দ্রীয় বাহিনী সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না, এটা ভারতীয় নির্বাচন কমিশন বলতে পারবে।
এমন ঘটনা ঘটেছে, তৃণমূল এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়েছে ভয় দেখিয়ে, পরে আবার সেই এজেন্টের বাড়িতেই তার খোঁজে হাজির হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী, তখন এজেন্টের মা আরও ঘাবড়ে গিয়ে জানিয়েছেন: তিনি তার ছেলেকে এজেন্ট হিসেবে আর কেন্দ্রে যেতে দেবেন না। এ রকম তৃণমূল কংগ্রেসের এজেন্টদের বিজেপি ভয় দেখিয়ে বের করে দিয়েছে। এখন কথা হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের সেই এজেন্টের বাড়িতে তাকে খুঁজতে যাওয়া- এটা ভারতীয় কেন্দ্রীয় বাহিনীর ক্ষমতার মধ্যে পড়ে কি না। ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের এটা জানাননো উচিত।
শুক্রবার অবশ্য নির্বাচন কমিশন সরাসরি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। যদিও এই ধরনের রিপোর্টে খুব একটা কার্যকরী কিছু হয় না। কারণ ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের আইন-কানুন অনুসারে নির্বাচনে সরকারি কোনো কর্মকর্তা যদি কোনো ইচ্ছাকৃত ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন অথবা নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে না পারেন, তাহলে তার বার্ষিক প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ফলে ভবিষ্যতে তাকে আর কোনো নির্বাচনী কাজে যোগ দিতে দেওয়া হয় না। এই হচ্ছে শাস্তির বিধান।
কেন্দ্রীয় বাহিনী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনেই কাজ করে। এই বাহিনী অবশ্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে কাজ করবে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত দুমাস ধরে কলকাতাসহ পশ্চিমবাংলার প্রায় সব জায়গা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের বিপক্ষে তার দলকে বিজয়ী করার জন্য।
২০১৬ সালে বিজেপি এখানে মাত্র তিনটি আসন লাভ করেছিল। তারপরে বহু জল গড়িয়েছে সর্বভারতের নানান জায়গায় নানা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিজেপি ২০১৬ নির্বাচনের পর এমন কি অর্জন করল যার ফলে পশ্চিমবাংলায় আজকে তাদের সেই তিন আসনকে ২০০ বানানোর স্বপ্ন দেখছে!
পহেলা এপ্রিলের নির্বাচন নন্দীগ্রাম ছাড়াও আরও ২৯টি আসনে সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু গতকাল সমস্ত দিন ধরে নন্দীগ্রামের বিভিন্ন ঘটনা, নির্বাচনের ব্যাপক অরাজকতা তুলে ধরেছে গণমাধ্যমগুলো। এরকম ঘটনার তেমন পাওয়া যায়নি অন্য আসনগুলোয়।
নন্দীগ্রামে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং যেভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই রাজ্যে দাপটের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচার করেছেন, তাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওপর সন্দেহ বৃদ্ধি পেয়েছে সবার। কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যদের মূলত নিয়ে আসা হয়েছে উত্তর প্রদেশ থেকে। যোগী আদিত্যনাথের প্রদেশ থেকে।
মোদি ও অমিত সাহা যখন গুজরাট চালাচ্ছিলেন, অমিত সাহা গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তখন গুজরাটের সেই ২০০২ সালের ঘটনা ঘটে। সেই সময়েও তথাকথিত এনকাউন্টার দ্বারা হত্যা করা হয়েছে অনেক নিরীহ মানুষকে। গুজরাট তখন একটি পুলিশি রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। তখনকার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গুজরাটের পুলিশ তাদেরকে সহযোগিতা করেছিল। এসব হত্যাকাণ্ডের মামলা শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেখানে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির সন্দেহজনক মৃত্যু হয়। যে বিচারপতির আদালতে মামলাটি চলমান ছিল, পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে মুক্তি লাভ করেন অমিত শাহ।
শ্রী অমিত সাহা এখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানেই তাদের সিবিআই, তাদের ইনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীসমূহ। সেদিক থেকে পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের কেন্দ্রীয় বাহিনী কতটুকু নিরপেক্ষ তা বোঝা গেল গতকালের নন্দীগ্রামের নির্বাচনে। নন্দীগ্রামে বিজেপি তার প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে আজকে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যে সাম্প্রদায়িকতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটতে চলছে, তার ইতিহাসটা দীর্ঘ। পশ্চিমবাংলায় স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছিল বহুকাল ধরে।
বাম শাসনের আগে পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস শাসনের সময় নকশালপন্থীদের সঙ্গে যে লড়াই চালাচ্ছিল তাতে বহু মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করেছিল কংগ্রেস। যার পরিণতিতে কংগ্রেস বাংলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে । ৪৪ বছরআগে কংগ্রেস পশ্চিমবাংলা থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। আজকে কংগ্রেস তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সেই বাম এবং একজন ধর্মীয় নেতা আব্বাস সিদ্দিকীর শরণাপন্ন হয়েছে। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আব্বাস সিদ্দিকী এবং বামদের সঙ্গে রাজ্য পর্যায়ে জোট গঠন সম্ভবত মেনে নিতে পারেনি। ফলে পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় কোনো নেতা-নেত্রী, কংগ্রেসের জনসভা কিংবা নির্বাচনী প্রচারের জন্য পশ্চিমবাংলায় তেমন আসেননি। এটাও পশ্চিমবাংলার নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের আইন অনুসারে নির্বাচন চলাকালীন সময়ে কোনো গণমাধ্যম নির্বাচনের আগাম ফলাফল প্রকাশ করতে পারবে না। অর্থাৎ নন্দীগ্রামের অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরে ভোটারদের মতামত প্রকাশ করার কোনো নিয়ম-বিধান নাই। যতদিন পর্যন্ত নির্বাচন চলবে, রাজ্যে ততদিন পর্যন্ত এই মতামত প্রকাশ করা যাবে না। সেজন্য আমাদেরকে ২৯ এপ্রিল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ভারতের পশ্চিমবাংলার নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলের জন্য। তারপরে আমরা আস্তে আস্তে জানতে পারব।
আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হবে ২ মে। তবে গত দুই দফার নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে গেল, ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের যে সুনাম ছিল দীর্ঘকাল, তা সত্যি সত্যি হয়তো দুর্বল হয়ে গেছে।
গণতন্ত্রের সঙ্গে আরও আছে গণমাধ্যম। প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত ১৪৫। আর নির্বাচন ফলাফল প্রকাশের পর বোঝা যাবে ভারতীয় ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্রব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছেছে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক