ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার ফল কখনোই ভালো হয় না
১২৯৯ সনে তখনকার সময়ের তুর্কমেন থেকে আসা ওসমান যে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন, তার নাম অনুসারে পরবর্তীকালে সেটি হয় উসমানীয় অথবা অটোমান সাম্রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। এদের পতনের পর তুরস্কের নেতা হন কামাল আতাতুর্ক। ১৯২০ সালের আগ পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের নিয়ন্ত্রণ ছিল অটোমানদের হাতে।
এই বিশাল সাম্রাজ্যের সময়ে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হয়েছিলেন সুলতান সোলেমান। তার সময়ে এই সাম্রাজ্য নানাভাবে বিকশিত হয়েছে; কিন্তু সর্বকালেই এই সাম্রাজ্যের অধিপতিদের বিরুদ্ধে নারী বিষয়ে সহিংসতার অভিযোগ ছিল। যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে পরাজিত বাহিনী কিংবা পরাজিতদের মেয়েদের এরা যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করত। এ রকম বেশ কিছু ঘটনার ইতিহাস পাওয়া যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে কামাল আতাতুর্ক দেশটিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যেতে চান, যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল আয়া সুফিয়া নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান ৫৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শাসক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা পর্যায়ক্রমে বহু বছর পরে দ্বিতীয় সোলায়মানের সময়ে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছিল।
কামাল আতাতুর্ক একজন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বার্থে এই আয়া সুফিয়ার ওপর মুসলমানদের একচেটিয়া কর্তৃত্বকে বিলুপ্ত করে একে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করেন। তবে একইসাথে স্থাপনার নানা অংশে ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রার্থনা করার ব্যবস্থা সংরক্ষণ করেন এবং ভেতরে নামাজের ব্যবস্থা ছিল যেমন, তেমনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক প্রার্থনার ব্যবস্থাও ছিল।
আয়া সুফিয়া নামক প্রতিষ্ঠানটিকে এরদোয়ান সরকার একটি জেলা পর্যায়ের আদালতের নির্দেশকে হাতিয়ার করে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করেছেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে খুশি করার লক্ষ্যে।
২০১১ সালে দেশ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতারোধের কনভেনশনের প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে ইউরোপের মধ্যে নিজেকে তুলে ধরে। ইস্তাম্বুলে স্বাক্ষরিত সেই কনভেনশন ইস্তাম্বুল কনভেনশন হিসেবে স্বীকৃতি পায়।পরবর্তীকালে আরও ১৩টি ইউরোপিয়ান দেশ যোগ দেয় এ কনভেনশনে। সেই সময় এতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এরদোয়ানের কন্যা।
এরদোয়ানবিরোধী একটি অভ্যুত্থানে ২০১৬ সালে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দীর্ঘকাল যাবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ফেতুল্লাহ গুলেন নামে একজন নির্বাচিত তুর্কি ধর্মীয় নেতা, যিনি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে অবস্থান করছেন। তার নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হতে যাচ্ছিল; কিন্তু এরদোয়ান রাশিয়ার সহযোগিতায় সেই যাত্রায় অভ্যুত্থানের হাত থেকে নিষ্কৃতি পান।
অভ্যুত্থানের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পরে কয়েক হাজার নানা শ্রেণির মানুষকে অভ্যুত্থানের দায়ে নির্যাতনের সম্মুখীন করা হয়। বিভিন্ন স্তরের সেনাবাহিনীর বেসরকারি-সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষকে চাকরিচ্যুত এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এরপর থেকেই গুলেনবিরোধী অপর ধর্মীয় গোষ্ঠী দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা এগিয়ে আসার সুযোগ পায়।
পৃথিবীর অন্যান্য মুসলি দেশের মতো তুরস্কে এরদোয়ান তার শাসন ব্যবস্থাকে দীর্ঘ ও শক্তিশালী করার জন্য ধর্মীয় একাংশকে নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করেন বেশ কিছু আইন-কানুন প্রণনয়নের মধ্য দিয়ে। তিনি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন আদায় করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য, ৬০০ বছর ধরে অটোমান এম্পায়ার যে শাসন ব্যবস্থা চালিয়েছিল, সেই সময়ও ধর্মীয় মতবাদ প্রাধান্য পেত।
এরদোয়ানও ধর্মীয় মতবাদকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার নেতৃত্বেই তুরস্ক কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে।
২০১১ সালে স্বাক্ষরিত নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী যে কনভেনশন, হঠাৎ করেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এক ডিক্রি জারি করে তা থেকেও বেরিয়ে আসেন। এর ফলে তার নিজের দল ও বিরোধী দলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। নারীরা রাস্তায় নেমে পড়েন এর প্রতিবাদে।
এই কনভেনশন থেকে বেরিয়ে আসার কারণ হিসেবে যে বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে, তা নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী কনভেনশন সম্পর্কিত নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নগুলোর বিভিন্ন দেশে সমকামিতা সম্পর্কিত বিভিন্ন বৈধতার ধারণার সঙ্গে তুরস্কের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মতপার্থক্যই মূল কারণ। যদিও নারীর সাথে সহিংসতার কোনো সম্পর্ক নাই সমকামিতার, তারপরও সমকামিতার বিষয়টিকে কারণ হিসেবে গ্রহণ করে এরদোয়ান এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছেন।
সমকামিতার বিষয়টি সামনে নিয়ে আনা হলেও আসল কারণ আমরা ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখি, গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সবসময়ই একনায়কত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা গ্রহণ করা হয়, যা তুরস্কেও ঘটেছে এই মুহূর্তে।
আমরা মনে করতে পারি পাকিস্তানে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোর অপসারণের পর জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানের মুসলিমপন্থীদের মনোরঞ্জনের জন্য শরিয়া আইন চালু করেছিলেন। এমনটা প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই আমরা লক্ষ্য করি: লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া... প্রায় সর্বত্র।
আমাদের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর আমরা এমন বেশ কিছু বিষয় লক্ষ্য করেছি এখানেও। কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার পথ হিসেবে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমকক্ষ হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। তারপরও এই কওমি মাদ্রাসার বিকাশ এত দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। আমরা দেখি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার মতন দুঃসাহসিক ঘটনাও ঘটে। এমনকি বিনা কারণে, বিনা অজুহাতে বাংলাদেশের সাথে ভারতীয় রাষ্ট্রের যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তা বিনষ্ট করার জন্য মোদির আগমনের পরে এক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দেশব্যাপী।
পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, ইরাক, লিবিয়া প্রায় সর্বত্রই গণতন্ত্রের ভীত দুর্বল। যেখানেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দুর্বল থাকে, সেখানেই দক্ষিণপন্থী মৌলবাদীদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতার সঙ্গে ক্ষমতায় থাকে একনায়কেরা। যেমন আমাদের দেশে এরশাদ হঠাৎ করে বিনা কারণে রাষ্ট্রের মৌলিক সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছিলেন। দেশের সংবিধানে মৌলিক আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা থাকা সত্ত্বেও এরশাদের সময়ে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছিল, যা আজও বাতিল করা হয়নি কিংবা বাতিল করা যায়নি; অথচ এই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মৌলিক ধারণার সাথে অবশ্যই সাংঘর্ষিক। তারপরেও সেই সময় এরশাদ দক্ষিণপন্থী মৌলবাদীদের খুশি করার জন্য অষ্টম সংশোধনী তার নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিয়েছিলেন।
তুরস্কের এরদোয়ান সরকারের এই নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী কনভেনশন থেকে বেরিয়ে আসার পিছনে একটি কারণ হলো, দক্ষিণপন্থীদেরকে নিজের দলে টানার সেই পুরনো কৌশল। আলটিমেটলি দক্ষিণপন্থীরা কখনোই কোনো স্বল্প পরিসরের তাদের মত প্রতিষ্ঠা মেনে নেয় না। তারা সব সময়ই পাকিস্তানের মতন একটি বিভক্ত সমাজে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়।
দক্ষিণপন্থীদের সাথে এই ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে একনায়ক দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। এই দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে সমঝোতার ফলে দেশের সামাজিক উন্নয়নের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সামাজিকভাবে উন্নয়নের জন্য যে পূর্বশর্তগুলো আছে, যেমন সাবালক বাচ্চাদের স্বাধীনতা, তার শিক্ষা, তার কর্ম, এবং তার বৈবাহিক জীবন- তা আমাদের মতন দেশগুলোতে দেখতে পাওয়া যায় না; এর ফলে সমাজ উন্নয়নের রাস্তা হারিয়ে ফেলে।
আমাদের দেশে আগামীতে কী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না; তবে সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণপন্থীদের যে নানা ঘটনা আমরা দেখতে পেয়েছি, তার ফলাফল উদ্বেগজনক। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন আইন পরিপন্থী অবস্থান ঘোষণা করেছে এই দক্ষিণপন্থী দলগুলোর নেতৃত্ব হেফাজত ইসলাম। রাষ্ট্র স্বীকৃত বৈবাহিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করে ধর্মীয় তত্ত্ব হাজির করেছে, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যেও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করাকেও একটি যুক্তি দেখিয়েছে- এসব আমাদের সমাজ জীবনের জন্য কত ভয়ঙ্কর, তা সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে।
আপাত অবস্থায় মনে হয়, সামনে আরও বেশি অনামিশা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
-
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক