ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট: কোভিড চিকিৎসকের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩তম সাইকেল কোভিড ডিউটি শেষ করলাম। গত এক বছর ধরে প্রতি মাসেই একটি করে সাইকেল ডিউটি করে আসছি। একেক সাইকেলের অভিজ্ঞতা একেক রকম। অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণগুলো প্রতি সাইকেল শেষে লিখে ফেললে ভালো হতো। এই সপ্তাহের পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরছি:
গত বছর বয়স্ক রোগী বেশি থাকলেও; এবার অনেক কম বয়সী রোগীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। চল্লিশ বছরের কম বয়স্কদের যদি কম-বয়সী হিসাবে ধরি; তাহলে বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলে কোভিড ওয়ার্ডে ভর্তি বয়স্ক ও কম-বয়সী রোগীর অনুপাত প্রায় ৩:১।
বয়স্ক রোগীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রোগী দুই ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। যারা ভ্যাকসিন পেয়েছেন তারা সবাই অন্য রোগীদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো আছেন এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। এটি আমাদের জন্য একটি ভালো খবর।
আগে অধিকাংশ রোগীদের পরিস্থিতির অবনতি হতো উপসর্গ শুরু হওয়ার দ্বিতীয় সপ্তাহে। কিন্তু, এখন প্রথম সপ্তাহে এমনকি উপসর্গ শুরু হওয়ার ৩ দিনের মাথায়- হঠাৎ করে রোগীর শারীরিক অবস্থা একদম খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
রোগীদের মৃত্যুর ব্যাপারে পূর্বের পর্যবেক্ষণ হলো, মৃতদের অধিকাংশই বয়স্ক রোগী, যাদের অন্য কোন অসুস্থতা ছিল। যেমন ডায়বেটিস, উচ্চ- রক্তচাপ বা কিডনি জটিলতা। কিন্তু, এখন অনেক কম বয়সী রোগীও মারা যাচ্ছে, যারা মাত্র ৩-৪ দিন আগেও দিব্যি ভালো ছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, জ্বর ও মাথা ব্যথা নিয়ে সন্দেহভাজন কোভিড হিসেবে অনেক রোগী ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হচ্ছেন। কিন্তু, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে তাদের কোভিড হয়নি, বরং ডেঙ্গু হয়েছে৷ আবার কোন কোন রোগীর একইসাথে কোভিড এবং ডেঙ্গু হচ্ছে।
কোভিডের এই তৃতীয় ধাক্কায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে অনেক রোগী আসছে। যারা উপজেলা ও জেলা সদর হাসপাতালে কোন শয্যা না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। গরীব এসব রোগী বাড়ি থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসতেই চিকিৎসার জন্য তাদের বরাদ্দ সব টাকা শেষ করে ফেলেছেন। ফলে অনেক সময় তাদের মূল চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হচ্ছে।
এবারের অধিকাংশ রোগীর প্রথম উপসর্গ শুধু মাথাব্যথা, অথবা পাতলা পায়খানা, অথবা দুটোই। তারপর ৩-৪ দিনের মাথায় হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট এবং কাশি। এসব রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন পরিমাপ করলে ৯০-এর কম পাওয়া যাচ্ছে এবং এক্সরে বা সিটি স্ক্যানে দুই ফুসফুসে নিউমোনিয়া পাওয়া যাচ্ছে অথচ কাশি বা শ্বাসকষ্ট শুধুমাত্র ১ দিনের।
এবার আমার ডিউটি ছিল সন্দেহভাজন কোভিড পুরুষ ওয়ার্ডে। নিশ্চিত কোভিড ওয়ার্ডে কোন শয্যা খালি না থাকায় আমরা সন্দেহভাজন ওয়ার্ডের একটি ব্লকে পজিটিভ রোগী রেখেছি। এছাড়াও, সন্দেহভাজন রোগীরা যাদের কোভিড পরীক্ষার ফলাফল পরবর্তীতে পজিটিভ এসেছে তাদেরকেও একই ওয়ার্ডে রাখতে হচ্ছে। আবার মহিলা ওয়ার্ডে কোন শয্যা খালি না থাকায়, পুরুষ ওয়ার্ডে মহিলা রোগী রাখা হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে এতে রোগী বা রোগীর স্বজনরাই আপত্তি জানাতেন। কিন্তু, এখন তারা একটি শয্যা ও অক্সিজেন পেয়েই সন্তুষ্ট এবং কৃতজ্ঞ।
আমরা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতার একদম কিনারে চলে এসেছি। সংক্রমণ এই হারে চলতে থাকলে আগামী সপ্তাহেই বাংলাদেশের সব হাসপাতালের সব শয্যা পূর্ণ হয়ে যাবে। এর পরের সপ্তাহে যারা আক্রান্ত হবেন- তাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আর কোন হাসপাতাল খালি থাকবে না৷
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ৷ তাই এবারের ডিউটির এই অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণগুলো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ভ্যারিয়েন্ট যেটাই হোক না কেন, একটি ভালো মানের মাস্কই আপনার-আমার রক্ষাকবচ। তাই মাস্ক পড়ুন এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র যেকোন একটি ভ্যাকসিন নিয়ে নিন।
- লেখক: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক।