গাধার জয়গান
'হাতির লেজ হওয়ার চেয়ে গাধার মাথা হওয়া ভালো।'– বাবা এই কথাটি বলে ছেলেবেলায় আমাকে এই মর্মে উপদেশ দিতেন যে, আমি ধর্ম, কর্ম, পড়াশোনা যা কিছুই করি না কেন, সেটা ভালো করে করতে হবে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সমাজবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষক– যা-ই হই না কেন, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাকে সেরাদের একজন হতে হবে।
তিনি হয়তো ইংরেজি প্রবাদ, 'ঘোড়ার লেজ হওয়ার চেয়ে গাধার মাথা হওয়া ভালো' অনুকরণ করে কথাটা বলতেন। ঘোড়ার বদলে কেন তিনি হাতির ব্যবহার করেছিলেন, তার পেছনে কোনো যুক্তি ছিল কি না, যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম।
গুগলে সার্চ করে ঘোড়া আর হাতির লেজ নির্লজ্জভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। হাতির লেজটা যেন মেয়েদের পাতলা চুলে বিনানো জৌলুসহীন চিকন বেণি। আর ঘোড়ার লেজটা দেখে মনে হলো কেশবতি কন্যার মাথার পিছন থেকে বাঁধা শ্যাম্পু করা পরিপাটি চুল তার পিঠের ওপরে ঝুলে আছে। ঘোড়ার লেজ যেন চুলের ঝর্ণা। আর হাতির লেজ হচ্ছে একটা লম্বা রশি। সেজন্য হয়তো বাবা মনে করেছিলেন, হাতির লেজ হওয়ার চেয়ে ঘোড়ার লেজ হওয়া ঢের ভালো।
৯০-এর দশকে আমাদের পৌর এলাকায় একাধিক মেয়াদে ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন বাবার এক বন্ধু। প্রতিবারের নির্বাচনে লটারিতে চাচা কাকতালীয়ভাবেই প্রার্থী প্রতীক হাতি পেতেন। উনি নিজেও দেখতে হাতির মতো স্বাস্থ্যবান ছিলেন। সক্রেটিস বলেছিলেন, 'নো দাইসেলফ'। আমরা বাপ-বেটাও দেখতে চাচার মতো ছিলাম। বড় মাথাওয়ালা। এসব কারণেই বাবা ঘোড়ার বদলে হাতিকে উপমায় টেনে এনেছিলে কি না, কে জানে!
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের প্রতীক হচ্ছে গাধা। প্রতীক হিসেবে নির্বাচিত হবার জন্য গাধার দৌড় শুরু হয়েছিল ১৮২৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের সময়। তিনি মার্কিনিদের কাছে 'জ্যাকঅ্যাস'হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। পরবর্তীকালে কার্টুনিস্ট টমাস ন্যাস্ট তার কার্টুনে ডেমোক্র্যাটদের বোঝাতে গাধার প্রতীক ব্যবহার করেছিলেন। সেই থেকে গাধা বনে যায় ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী প্রতীক। আর হাতির প্রতীকটি রিপাবলিকানরা পেয়ে যান ১৮৬১ সালে। সে সময়ে হাতির পরিবর্তে দ্রুতগামী চতুষ্পদ জন্তু ঘোড়ার প্রতীকই তো ব্যবহার করা যেত। অন্যদিকে, ১৮৭৪ সালে আঁকা কার্টুনে ন্যাস্ট রিপাবলিকানদের প্রতীক হিসেবে তুরগের পরিবর্তে হাতিই ব্যবহার করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এখনো ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের জন্য এ দুই প্রতীকই ব্যবহৃত হচ্ছে। গাধা বা হাতি যা-ই হোক না কেন দুটি সওয়ারিই নিরীহ প্রকৃতির। এ সাদৃশ্য থাকায় বাবা হয়তো ঘোড়া আর গাধার চেয়ে গাধা আর হাতির মধ্যে তুলনা করার চেষ্টা করেছিলেন।
সে যা হোক, হাতি ঘোড়া যাক তল। প্রকৃতপক্ষে, গাধা ঘোড়ার মতো দ্রুতগামী নয়, এ কথা সত্যি; কিন্তু সে বেশি ধৈর্যশীল। অতি মলিন অনুত্তম রাস্তার উত্তম বাহন। গাধাকে ভয় দেখিয়ে বা জোর করে এমন রাস্তায় নিয়ে যাওয়া যাবে না– যে রাস্তায় যাওয়াটাকে সে বিপজ্জনক মনে করবে। বিষয়টাকে এ রকম করে ভাবা যায় যে, গাধারা খুব সহজে বিপথগামী হয় না। কিন্তু ঘোড়া এই কাজটা সহজেই করে ফেলে।
গাধারা বেশ কাজের। সৎ, সতর্ক, কর্মঠ এবং বুদ্ধিমান। শেখার ব্যাপারে আগ্রহী। ইংরেজি প্রবাদ 'স্লৌ অ্যানড স্টেডি উনস দ্বি রেইস'। এর মর্মার্থ হচ্ছে, 'অধ্যবসায়ের ফলেই সাফল্যের লাভ ঘটে'। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, গাধা (অনেকে তাদের এ নামে সম্বোধন করে) ছাত্ররা একটা জিনিস বারবার পড়ে শিখে যায়। ভালোভাবে রপ্ত করে ফেলে। আর অনেক দুর্দান্ত মেধাবীদের দেখেছি খরগোশের মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুমাতে।
হুমায়ুন আজাদের প্রবচন, 'আমরা প্রশংসা করি সিংহের, কিন্তু পছন্দ করি গর্দভ (গাধা) কে।' বিয়ের পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে এবং সংসার টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তার প্রবচনটির অনুসরণ বেশ কাজে আসতে পারে। উল্লেখ্য যে, ঢাকায় বর্তমানে দৈনিক ৩৯টি তালাকের ঘটনা ঘটছে। অংকে প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে।
'বাবা, গাধারা কি বিয়ে করে?' 'হ্যাঁ বাবা, গাধারাই বিয়ে করে।'– গাধা নিয়ে কৌতুকগুলোর মধ্যে এ রকম একটা কৌতুক আমরা প্রায়ই শুনি। আরবি ভাষার একটা প্রচলিত প্রবচন 'আনা আমির, আন্তা আমির। মান্ ইয়াসুকাল হামির?' এর বাংলা মানে হচ্ছে, এই রকম সবাই প্রিন্স হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে সংসার কীভাবে চলবে? তাই কর্মঠ গাধারাই সংসারে সবচেয়ে বেশি সফল। বন্ধুবৎসল এবং আমুদে।
'গাধার পর গাধা, তারপর আমি, তারপর জাতি, বাবার কাছে 'Assassination' ইংরেজি শব্দের বানানটা এভাবেই বাক্যাংশের সাহায্যে শিখেছিলাম স্কুলজীবনে। ভাষা শিক্ষায়ও গাধার ব্যবহার লক্ষণীয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও গাধার অবদান অনস্বীকার্য। গাধার চামড়ার নিচে জিলাটিন নামে বিশেষ এক ধরনের আঠা থাকে। এই জিলাটিন দিয়ে চীনারা তৈরি করছে তাদের চিকিৎসা জগতে ব্যবহৃত কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ওষুধ এজিওয়া।
এজিওয়া মূলত অ্যাজমা উপশমে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রতিবছর এই ওষুধের চাহিদা মেটাতে চীনের প্রয়োজন পড়ে প্রায় ৫০ লক্ষ গাধার চামড়ার।
২০১৭ সালে গাধার প্রজনন ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চীন পাকিস্তানকে পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছিল। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, অ্যাজমা ও অনিদ্রার বিশেষ ওষুধ এজিওয়া তৈরিতে চতুর চৈনিকদের ছুরিতলে কত গাধার প্রাণ হচ্ছে বলিদান।
উহানের বাজারের ব্যতিক্রম খাদ্য বাদুড়ের স্যুপ কিংবা সাপ, নাকি খাটাশের মাংস থেকে প্রথম করোনাভাইরাস ছড়িয়েছিল, তা নিয়ে সারা বিশ্বে জল্পনা-কল্পনা কম হয়নি।
গাধা উৎপাদনে পাকিস্তান বিশ্বে তৃতীয়। শুনেছি, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পাকিস্তানে আদমশুমারির সঙ্গে সঙ্গে গাধাশুমারিও চলত। এ রকম এক গাধাশুমারিতে দেখা গেল, তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মোট গাধার সংখ্যা ছিল ৩৩১টি। এ দেখে জেলা প্রশাসক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে মজা করে বলেছিলেন, 'সংখ্যাটি আরও ২ বাড়িয়ে ৩৩৩ করে দিন। তাতে সংখ্যাটি সুন্দর হবে। আর ওই দুটির একজন হলাম গিয়ে আমি এবং অন্যজন আপনি।'বহুল প্রচলিত এই গল্প থেকে পরিসংখ্যান তথ্য-উপাত্তের যথার্থ রূপ উপলব্ধি করা যায়। এজন্যই অনেক ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় না।
একদা একটা গাধা গর্তে পড়ে যায়। তাকে যে-ই দেখতে আসে, সে-ই তার গায়ে এক বালতি আবর্জনা ফেলে যায়। গাধাটি তাতে আনন্দিত হয়। খুশিতে নাচতে থাকে। তাতে উৎসাহিত হয়ে আরও লোকজন এসে তার গায়ে ময়লা ফেলতে থাকে। এভাবে একটা সময়ে পুরো গর্তটা ভরে যায়। আর তখনই গাধাটি তার গায়ের সমস্ত ময়লা ঝেড়ে ফেলে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে।
বর্তমানে পরচর্চা, পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি নিন্দনীয় অসদাচরণ, কথাবার্তা, যাবতীয় অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অবৈধ লেনদেন আমাদের সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করছে। তাদের নিবারণ করা সম্ভব না হলে গল্পের গাধার মতো করেই আমাদের গায়ে ছুড়ে মারা ময়লা ঝেড়ে ফেলে আনন্দ খুঁজে পেতে হবে। সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ষড়রিপুর তাড়নায় স্বীয় অশুভ স্বার্থ চরিতার্থ করবার নিমিত্তে, অন্যের জন্য নিকৃষ্ট জনের খোঁড়া গর্ত থেকে ভুক্তভোগীকে এভাবেই বেরিয়ে আসতে হবে। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
বৈষয়িক ব্যাপারে ব্যস্ত এই সমাজের চতুর ও চটুল লোকদের কাছে ভালোমানুষ ও বোকাদের অপর নাম হচ্ছে গাধা। সামাজিক বৈষম্য ও ভেজাল সংস্কৃতিকে তীক্ষ্ণ ভাষায় ব্যঙ্গ করে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী কৃষণ চন্দর লিখেছিলেন উপন্যাস 'আমি গাধা বলছি'। গাধার জবানিতে তিনি সমাজের নানারকম অসঙ্গতি এবং মানুষের জীবনের দুর্গতিকে অনেক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি গাধাকে ভালো মানুষের সাথে তুলনা করেছেন। উপন্যাসের শেষ লাইনে তার মূল্যায়ন হলো, 'গাধা, জীবনের শ্রম এবং ভালো মানুষী দিয়ে গড়া এক নিষ্পাপ সত্তা।'
মহামারির এই দুভোর্গের মাঝে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা আমার এক কলিগ জটিল একটা বিষয় আমাকে অনলাইন মুডে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টার পর যা আমার ঘটে ডুকেছিল, তা কলিগকে লিখে জানালে তিনি বললেন, 'ইউ আর অ্যাবসলুটলি রোঙ।' আমি লজ্জিত হয়ে কী করি ভাবলাম। ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগোর লেখা বিশ্বের সবচেয়ে ছোট চিঠিটির কথা মনে পড়ল।
একটা সময়ে এ চিঠিপত্রই ছিল মানুষের যোগাযোগ এবং ভাব আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। চিঠিতে মানুষ লিখে পাঠাত রাজ্যের কথা। মান-অভিমানের কথায় কিংবা খুনসুটিতে ভরে যেত কারও কারও চিঠির পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। কেউ-বা আবার অল্প কথায় ছোট্ট করে চিঠি লিখত। ১৮৬২ সালে ভিক্টর হুগো চিঠিতে কেবলমাত্র একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন '?' দিয়ে প্রকাশকের নিকট জানতে চেয়েছিলেন তার বই 'লা মিজারেবলস'কেমন বিক্রি হচ্ছে। প্রকাশকও কম যাননি। তিনি উত্তরে পাঠিয়েছিলেন শুধু আশ্চর্যবোধক চিহ্ন '!'। মানে বইটা অনেক বিক্রি হচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, যে বইয়ের ব্যাপারে জানতে ভিক্টর হুগো পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট চিঠিটি লিখেছিলেন, সেই বইটা কিন্তু মোটেই ছোট ছিল না। সেটা ছিল বারোশ'র বেশি পৃষ্ঠার একটা বই।
দিনটি ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন। ভিক্টর হুগোর চিঠিটার অনুকরণে কলিগকে উত্তর দিলাম, 'আই অ্যাম অ্যা ডেমোক্র্যাট।' বেশ কিছু দিন পর সেই সহকর্মীর সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, 'আপনার পার্টি তো অবশেষে নির্বাচনে জিতল। শুনেছি, ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন জো বাইডেন।'
- লেখক: বুয়েট শিক্ষক ও কলামিস্ট