কেবলমাত্র সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক তৃণমূলকে রক্ষা করবে না
পশ্চিম বাংলা রাজ্য নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলে যা বেরিয়ে আসে তাহলো মমতা ব্যানার্জির ও তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে সংখ্যালঘু ভোটাররা। রাজ্যের ২৯৪টি আসনের মধ্যে ৭৪টি আসন সংখ্যালঘু প্রাধান্য আসন। এই ৭৪টি আসনে গড়ে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ মুসলিম ভোটার। ৭৪টি আসনের মধ্যে দুটি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ৬৯টি আসনে জয়লাভ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দুইটি আসনে বিজেপি ও একটি আসনে নবগঠিত ফুরফুরা শরীফ পীর আব্বাস সিদ্দিকীর দল জয়লাভ করেছে।
তবে পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে আসন সংখ্যার দিক থেকে তৃণমূল কংগ্রেস যতই এগিয়ে থাকুক না কেন প্রদত্ত ভোটের শতাংশ হারে খুব বেশি দূরে নয়। প্রদত্ত ভোটের মোট শতাংশ হারে ৯ থেকে ৯.৫ শতাংশ ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস বিজয়ী হয়েছে। প্রদত্ত ভোটের ৪৭.৯ শতাংশ ভোট তৃণমূল কংগ্রেস অর্জন করেছে আর বিজেপি পেয়েছে প্রায় ৩৮.১ শতাংশ ভোট। সুতরাং এই ৯ শতাংশ ভোটের ব্যবধান নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস যদি তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে তাহলে খুব ভুল হবে । প্রকৃত রাজনৈতিক সংস্কার যদি তারা পশ্চিমবাংলায় শুরু করতে না পারে, বাস্তবায়ন করতে না পারে; তাহলে আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। কেবলমাত্র সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক তৃণমূলকে রক্ষা করবে না।
ভোটের রাজনীতিতে এই সংখ্যালঘুরা যতখানি তৃণমূল কংগ্রেসকে এগিয়ে রেখেছে সমাজ উন্নয়ন ও তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গত ১০ বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছ থেকে কি অর্জন করেছে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অর্থনৈতিকভাবে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এখনও ব্যাপক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। শিক্ষার হার, রাজ্য পর্যায়ে রাজ্য সরকারের চাকরিতে যোগদানের হার, রাজ্য সরকারের পুলিশ সদস্যের মধ্যে এদের অবস্থান--সবকিছু সামনে নিয়ে আসলে দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার আগে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান ছিল তা মূলত অপরিবর্তিত। পার্থক্য বামফ্রন্টের সময়কালের সঙ্গে একটি মাত্র বিষয়ে, তা হচ্ছে সংখ্যালঘু হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকা। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনে সংখ্যালঘুদের এই দুশ্চিন্তা ছিল না। ওই সময়ে পশ্চিমবাংলায় তেমন কোনো সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখা যায়নি।
কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের আসামের মতন এনআরসি চালু করার ঘোষণা সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব হারানোর আতঙ্কের মধ্যে ঢুকিয়েছে। তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি সুযোগ হিসেবে এনআরসির বিষয়টির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে এই সংখ্যালঘু মানুষদেরকে আশ্বস্ত করেছেন। পশ্চিমবাংলায় এনআরসি হতে দিবেন না তিনি। বলা যেতে পারে এই ইস্যুটি প্রাধান্য পেয়েছে সংখ্যালঘুদের ভোট প্রাপ্তির প্রধান কারণ হিসাবে। এছাড়া খুব সহজ রাস্তা হিসেবে ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল কংগ্রেস মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন ভাতা চালু করে সংখ্যালঘুদের মন জয় করেছেন মমতা ব্যানার্জি।
সংখ্যালঘুরা তাদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক জীবনের উন্নয়নের দিকে যত না লক্ষ্য রেখেছে তার থেকে বেশি লক্ষ্য তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের স্বাভাবিক অবস্থার প্রাপ্তির প্রতি। এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শিক্ষা ব্যবস্থায় মূলত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। পশ্চিম বাংলা রাজ্য সরকারের বিধি অনুসারে মাদ্রাসাগুলোর নির্ধারিত সংস্কার সম্পন্ন হলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যয় প্রধানত রাজ্যের বহন করার কথা। কিন্তু গত দশ বছরে এই ধরনের মাদ্রাসা সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পরেও রাজ্য সরকার তাদেরকে রাজ্যের আওতায় গ্রহণ করে নাই। বিষয়টা আমাদের দেশের সরকারি সুবিধা প্রাপ্তির মতন অনেকটা (এম পি ও ভুক্ত হওয়ার মতো), যদিও বাম শাসনামলে এ ধরনের মাদ্রাসাগুলোকে ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে গত ১০ বছরে তৃণমূল কংগ্রেস তেমন মনোযোগ দেননি মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়নে। এই বিষয়গুলোকে সামনে না নিয়ে এসে সংখ্যালঘুদের মধ্যকার উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা তৃণমূল কংগ্রেসের কাছ থেকে নানান আর্থিক সুবিধা যেমন আদায় করেছে তেমনি এই জনগোষ্ঠীর প্রধান অংশকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে, তৃণমূলের পক্ষে ভিড়িয়েছে সংখ্যালঘু দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের।
এবার নির্বাচনে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় তা হল ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের ২১১ জন বিজয়ী বিধানসভার সদস্যদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু ব্যক্তিত্ব ছিল, এবার সেই সংখ্যা ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিমবাংলার ক্ষমতায় তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত থেকে যে বার্তা ভারতীয় সমাজকে দেওয়ার চেষ্টা করছে, যে রাজ্যটি এখনো একটি ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থান ধরে রেখেছে, কিন্তু এটা কতটুকু সত্য আগামী দিনগুলো তা প্রমাণ করবে।
হিন্দু মহাসভার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে জয়লাভ না করলেও বিধানসভায় যে ৭৭টি আসন পেয়েছে তাতে তারা এখন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তাই প্রমাণ করে। আগামী নির্বাচনে অর্থাৎ আজ থেকে ৫ বছর পরে যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেই সময়ে এই রাজ্যটির কি অবস্থা হবে তা এখনই বোঝা দুষ্কর। কারণ অতীতে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবাংলায় এই বিজেপি দলটি ক্ষমতা হারিয়েছিল। এ ঘটনা অটল বিহারী বাজপাই যখন কেন্দ্রে ক্ষমতা হারিয়ে ছিলেন তখনকার। তেমনি বিজেপি যদি আগামী ২০২৪-নির্বাচনে কেন্দ্রে সাফল্যলাভ না করে তাহলে পশ্চিমবাংলার আপাত সাফল্য ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি এ কথাও বলা যাবে না যে পশ্চিমবাংলায় যে ধর্মীয় চূড়ান্ত বিভাজন সংঘটিত হয়েছে তা দ্রুত হ্রাস পাবে।