ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কেন কথা বলতে হবে?
বিশ্বজুড়ে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (Menstrual Hygiene and Health Management-MHM) নারী ও কিশোরীদের প্রজননকালের একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের পিরিয়ড হওয়াটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়েও পিরিয়ড এবং ঋতুকালীন অনুশীলনগুলি এখনও অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কুসংস্কার ও সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি, যা যথাযথ ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পথে একটি বড় অন্তরায়।
বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটি চল্লিশ লাখ নারীর পিরিয়ড হয় এবং তাদের মধ্যে একটি বিপুল সংখ্যক মেয়েরা হলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগামী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজেন সার্ভে-২০১৮ অনুসারে, প্রায় ৫০ শতাংশ কিশোরী মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের পরিবর্তে অস্বাস্থ্যকর পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। পিরিয়ডের সময় দেশের অনেক কিশোরীই স্কুলে যায় না এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে পরীক্ষায়ও অংশ নেয় না। কারণ, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বান্ধব টয়লেট নেই। টয়লেটগুলোতে জরুরি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ থাকে না এবং ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলার জন্যও থাকে না কোনো স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা। অথচ গড়ে একজন শিক্ষার্থী পিরিডের সময় ৭-৮ ঘন্টা স্কুলে থাকে সেজন্য স্কুলগুলোতে জরুরি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ এবং তা ফেলার স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা থাকা দরকার। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর ন্যাপকিন পাল্টানো দরকার, তা না হলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে এবং নানা রোগ দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজেন সার্ভে ২০১৮-এর তথ্য মতে, স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের হার ৬২% এবং বাকি ৩৮% এখনও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে না। অর্থাৎ এই ৩ ভাগের ১ ভাগ মেয়েদের হয়তো স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সামর্থ্য নেই অথবা তাদের কাছে এগুলো সহজলভ্য নয়। জরিপে আরও উঠে এসেছে যে, 'দেশের বেশিরভাগ স্কুলে মেয়েদের জন্য পৃথক এবং ব্যবহারের উপযোগী টয়লেট না থাকায় ঋতুকালীন সময়ে প্রতি ৩০ শতাংশ ছাত্রীকে প্রতি মাসে স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে হয়'। ফলে তারা একদিকে ক্লাসে পিছিয়ে পড়ে, অন্যদিকে পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ হয়।
এরকম পরিস্থিতিতে উন্নয়ন সংস্থা র্ডপ জেলাসদর ভোলা ও চর উপজেলা রামগতিতে গত ২-৩ বছরে প্রায় ৩০টি উচ্চবিদ্যালয় ও মাদ্রাসার এই বিষয়ে ব্যবহারিক কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে দেখার চেষ্টা করে, সমস্যাটা কোথায়? পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে আলাদা টয়লেট স্থাপন হচ্ছে না, যা ব্যবস্থাপনার অভাব বিশেষ করে দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা, নাকি সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণের অভাব। ২টি বিষয় এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান, একটি ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনার অভাব এবং ন্যাপকিনের প্রাপ্যতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের পানি-স্যানিটেশন বিষয়ক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মনযোগ, বাজেট বরাদ্দ এবং মনিটরিং- এর অভাব। স্কুলসহ এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় মূল যে বিষয়টি, টয়লেট বা পর্যাপ্ত MHM Friendly টয়লেট-এর সংস্কার বা স্থাপন হচ্ছে না। এই প্রেক্ষিতে ভোলা ও রামগতির নির্ধারিত কিছু স্কুলগুলোতে AWIS (অ্যানোটেটেড ওয়াটার ইন্টিগ্রিটি স্ক্যানিং) টুলস নামের শুদ্ধাচার বিষয়ক কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর গবেষণার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা স্কুলের পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। তারা স্যানিটেশন সুবিধার মান, জেন্ডার, ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (এমএইচএম), অন্তর্ভুক্তি ও বাজেট ব্যয় মূল্যায়ন এই ৫টি বিষয় স্থানীয়ভাবে তুলে আনে। এই গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, পরিষেবা সরবরাহকারী/ স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে শুদ্ধাচার অনুশীলন ব্যতীত স্কুলগুলোতে পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সংবেদনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। অপরাপর দেশসমূহের মতো বাংলাদেশও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে অঙ্গীকারাবন্ধ। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৭ টির মধ্যে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয় নি। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৪ (সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুনগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি) এ বিদ্যালয়ে আলাদা টয়লেটের কথা বলা হলেও এই MHM বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করা হয় নি।
এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিষেবা সরবরাহকারী এবং গ্রহণকারীদের মধ্যে শুদ্ধাচারের (স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং অংশগ্রহণ) অভাব রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৫ সালে জারিকৃত বিদ্যালয়ের ওয়াশ বিজ্ঞপ্তি- ২০১৫-তে বর্ণিত ১১ নির্দেশনায় ছাত্র ও টয়লেটের অনুপাত ১৮৭: ১-এর মতো রূঢ় বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। যদিও সেক্টর উন্নয়ন পরিকল্পনা (এসডিপি) ২০১১-২০২৫-এ ছাত্র ও টয়লেটের কাঙ্খিত অনুপত ৫০: ১ নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এটি বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে; যেখানে ভোলা এবং রামগতিতে প্রায় ১২৬ জন শিক্ষার্থী একটি টয়লেট ব্যবহার করছে।
কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে মান নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি অংশীদারদের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে। ওয়াশ সেক্টর স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে কিন্তু বিদ্যালয়ের ওয়াশ সেক্টর দেখভাল করার জন্য নিদিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ নেই। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সুবিধা সমীক্ষা ২০১৪, বাংলাদেশ জনতাত্ত্বিক ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৭, বাংলাদেশ ডব্লিউএসএস সেক্টর ২০১২-এর জন্য জাতীয় স্বাস্থ্যবিধি প্রচারের কৌশল, এসডিজি ফিনান্সিং কৌশল ২০১৭-এ ওয়াশের ক্ষেত্রে বিনিয়োগে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোন নির্দেশনা নেই। এটা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে অধিকতর স্বচ্ছতার প্রয়োজন আছে।
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রথম স্তরের স্বাস্থ্য কর্মী এবং উপযুক্ত এনজিও কর্মীদের মাধ্যমে স্কুল-ভিত্তিক সচেতনতাবৃদ্ধি কর্মসূচিসহ মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের পর্যাপ্ত সুবিধা রেখে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কর্নার ও পরিষ্কারের উপকরণসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক পৃথক টয়লেট সুবিধা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন প্রজননস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইস্যুতে তাদের সুরক্ষাকারীদের (পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, সহকর্মী, ইত্যাদি) আচার-আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন সৃষ্টি করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সরকারের উদ্যোগ, বিভিন্ন বিভাগগুলির নীতি-সহায়তায় মনোযোগ ও সমর্থন ছাড়া পরিস্থিতি বদলানো কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়- সকলেই ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কাজ নিয়ে সম্মিলিতভাবে জড়িত।
করণীয়:
ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কৌশল ২০২০-এ নির্দিষ্ট গাইডলাইন এমনভাবে সংযুক্ত করা প্রয়োজন; যেখানে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের সাথে সামঞ্জস্য থাকবে, অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব উল্লেখ থাকবে, বাজেট বরাদ্দ এবং নিরীক্ষণ কর্তৃপক্ষ কৌশল বাস্তবায়নের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।
- সংশোধিত ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কৌশল জেন্ডার লেন্সের মাধ্যমে এমনভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত, যাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া কিশোরী এবং প্রতিবন্ধী মেয়েরা পিছিয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত হয়।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিরিয়ড চলাকালীন পর্বে মেয়েদের কম খরচে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করা দরকার যাতে তারা বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসা চালিয়ে যেতে পারে।
- সামাজিক এবং আচরণগত পরিবর্তনের জন্য যোগাযোগ এবং বিস্তৃত পরিসরে বাস্তবায়ন পরিকল্পনা কৌশল উত্থাপন ও প্রচারের ওপর জোর দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক বিদ্যালয়গুলোতে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কৌশল পরিচালনার জন্য গাইডলাইন প্রণয়ন ও অনুসরণ নিশ্চিত করা দরকার।
- লেখক:
- যোবায়ের হাসান (গবেষণা পরিচালক, র্ডপ) ও
- জেসমিন মলি (গবেষণা সহযোগী, র্ডপ)