ঋণ-খেলাপির চরিত্র বিশ্লেষণ ও কিছু জরুরি কথা
কথা দিয়ে যারা কথা রাখেন না তারা কথার খেলাপকারি, তারা সমাজে অবিশ্বস্ত। আর ঋণ নিয়ে যারা ফেরত দেন না তারা ঋণ খেলাপি, তাঁরাও চুক্তি ও বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধে অপরাধী- কথাটি খুব সহজ ও প্রাঞ্জল তাতে সন্দেহ নেই। যে কেউ বুঝতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সমাজে একজন কথার খেলাপকারি যতটুকু নিন্দিত, একজন ঋণ খেলাপি তেমনভাবে নিন্দিত নয় বরং তারা সমাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুরস্কৃত। আমরা সাধারণেরা মনে করি ঋণের খেলাপ করা বড়দের ব্যাপার। যারা ছোট তাদের এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারটা কি? খুব সত্যি কথা সবার সবকিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হতোনা হয়তো। কিন্তু যখন সমাজের একটা অংশের কাজ অন্য সবার দুঃখের কারণ হয়, যখন একজনের খারাপ কাজ অন্যকে সংক্রমিত করে, অনেককে ভোগায়, ক্ষতিগ্রস্ত করে, অন্যদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তখন সবার সম্মিলিত বোধ ও প্রতিরোধ ছাড়া সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয় না।
সময়টা সত্তর দশকের মাঝামাঝি হবে। আমি তখন ছোট। আতিয়ার নামে আমাদের গ্রামে একজন চোর ছিল। গ্রামে কোনকিছু চুরি হলে তাকে খুঁজে বের করা হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে জানত চুরি যাওয়া জিনিসটা কোথায় কারণ হয় সে চুরি করত অথবা চুরির একটা খোঁজ সে দিতে পারতো। একদিন সকালে শুনলাম আতিয়ার ধরা পড়েছে। আমরা দলবেঁধে তাকে দেখতে হাজির হলাম। দেখি রাস্তার পাশে একটা গাছে উলটো করে ঝুলানো হয়েছে তাকে। মাথা মাটি থেকে দুই তিন হাত উপরে ঝুলছে। গ্রামের অর্ধেক লোক সেখানে জড় হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আতিয়ারের আত্মীয়স্বজনও আছে। সে খুব জোরে জোরে চিৎকার করছে, যন্ত্রণায়, বেদনায়। তার ৩-৪ বছর বয়সী ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদছে আর তার বাবাকে ছেড়ে দিতে অনুনয় করছে, তার বউয়ের চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। এক একজন সৎ (?) ব্যক্তি তাকে ইচ্ছেমত পেটাচ্ছে। আমরা ৪-৫ বছরের ছেলেমেয়েরা দূর থেকে দেখছি আর ভয়ে কাঁপছি। চোরকে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অমানবিকভাবে পেটাল তারই প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন। কী ছিল তার অপরাধ?
গভীর রাত, বাসায় খাবার নেই। তার ছেলে, বউ এবং সে কিছুই খায়নি। শিশু বাচ্চার ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে পাশের এক রান্নাঘরে ঢুকেছে চোর। পাতিল থেকে ভাত, তরকারী আর ডাল চুরি করে সবাই মিলে খেয়েছে। সেই বড় (!) অপরাধে তাকে গাছের সাথে উলটো করে বেঁধে গ্রামের ধনী প্রতিবেশীরা তাকে তার ছেলে বউয়ের সামনে, বাবা-মায়ের সামনে, সারা গ্রামবাসীর সামনে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। চোরের সঠিক শাস্তি হয়েছে, এমন না হলে সমাজ থেকে চুরি ডাকাতি বন্ধ হবে কীভাবে(!)?
এই ছোট ঘটনাটি আমি কখনো ভুলতে পারিনি। জীবনের নানা বাঁকে এই ঘটনা আমার মনকে বিদীর্ণ করেছে। সময় গড়িয়েছে, চুরি-ডাকাতির ধরণ আধুনিক হয়েছে, কালক্রমে একটা বালিশের দাম হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা, সেই বালিশ ফ্লাটে উঠাতে খরচ পড়েছে ৯৩১ টাকা (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের গ্রিন টিসি হাউজিং প্রকল্প), করোনার এই দুর্যোগকালীন সময়েও স্বাস্থ্য খাতের এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই ক্রয়ের দুর্নীতি সবার নজরে আসে, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় ডজন ডজন ঋণ খেলাপি, দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকায় বিদেশে গড়ে উঠে বিভিন্ন অভিজাত এলাকা, ব্যাংকের ঋণ না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গুলি করেন বড় ব্যবসায়ী এবং পরবর্তীতে তারাই আবার সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পালিয়ে যান।
আমরা জানি চোর কাজ করে খুব গোপনে, কোনভাবে ধরা পড়লে তার সমূহ বিপদ, সবাই তাকে মেরে নাস্তানাবুদ করবে, এমনকি প্রাণে মেরে ফেলবে। মেরে ফেলার ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। ছিনতাইকারীও একধরণের চোর কিন্তু তার চুরির ধরন হচ্ছে সে আপনার অসতর্ক মুহূর্ত বেছে নেবে। তার কাজও খুব ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে ডাকাতের কাজ হচ্ছে অস্ত্র ঠেকিয়ে আপনার সর্বস্ব লুট করে নেওয়া। তার হাতে আপনি পরিবারসহ নিগৃহীত হতে পারেন, সম্পদ মানসম্মান খোয়াতে পারেন।
ঋণ খেলাপি কারা, তাদের স্বরূপ কি, তারা কোন গোত্রভুক্ত সেটা নিয়ে সবার চিন্তা করা উচিত। তারা কি দেশ ও দশের শত্রু নাকি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজ বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা আছে, এসব জানতে পারলে তাদেরকে মূল্যায়ন করা সহজ হবে এবং এই মহামারী শেষ হলে নতুন পরিস্থিতিতে সেটার প্রয়োজনও দেখা দেবে কারণ দেশের ব্যাংকিং সেক্টর তাদের কারণে খুব বেশি প্রভাবিত হয়েছে এবং হবে।
যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না বা দেন নাই তারাই ঋণ খেলাপি- এটাই সহজ সংজ্ঞা। মোটা দাগে ঋণ খেলাপি দুই ধরণের। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি ও অনিচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি।
ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হচ্ছে তারা, যারা ঋণ নেয়ার আগে থেকেই খেলাপি মন মানসিকতা নিয়ে ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হন ঋণ পাবার জন্য। তারা জানেন তারা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিবেন না। এই ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে থাকেন লম্বা একটা স্বার্থান্বেষী মহল। ঋণ আবেদন থেকে শুরু করে ঋণ বিতরণ- এই পুরো প্রক্রিয়ায় যারা জড়িয়ে থাকেন এবং যারা এই ধরণের ঋণের জন্য তদবির করেন সবাই এখানে লাভবান হন। বিদেশ থেকে মেশিন আনা হয় ১ কোটি টাকার কিন্তু দাম ওভার ইনভয়েসিং করে দেখানো হয় ১০ কোটি বা বিশ কোটি টাকা, জমির বা বিল্ডিং এর দাম দেখানো হয় শতগুণ। তদবিরকারি, ঋণ গ্রহিতা, ব্যাংকার, সার্ভেয়র, উকিল সবাই এই প্রক্রিয়ায় একে অপরের সহযোগী হয়ে এই অন্যায় কাজটি করেন। সবাই জানেন যে এই ঋণ ফেরত আসার সম্ভাবনা খুব কম তার পরেও তারা এই কাজটি করেন এবং প্রত্যেকে তাদের প্রাপ্য অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেন। সচেতন পাঠককে এখন চিন্তা করতে হবে এরা কোন গোত্রভুক্ত। ব্যাংকে জনগণের টাকা গচ্ছিত থাকে, সেই টাকা যারা অন্যায়ভাবে স্যুট-কোট-টাই পরে শত শত ডকুমেন্ট সই করে, সব লিগ্যাল ফর্মালিটি পালন করে ব্যাংক থেকে বের করে নিয়ে যায় এবং আর ফেরত দেয়না তারা কি চোর, ছিনতাইকারী, ডাকাত নাকি তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু। অবশ্য সেই সংজ্ঞা দেয়া কঠিন বিষয়। আব্দুল হাই বাচ্চুর সময়ে বেসিক ব্যাংকে, পরবর্তীতে ফারমার্স ব্যাংকে (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) যে বেশির ভাগ ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে তার অধিকাংশই স্বেচ্ছা খেলাপের আওতায় পড়ে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে সরকার অনেকের ব্যক্তিগত দায় কাঁধে নিয়েছে যেটা সঠিক বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে অনিচ্ছাকৃত খেলাপির মধ্যে তারা পড়েন যারা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন অন্যকারণে। যেমন কেউ ব্যবসা করতে গিয়ে অদক্ষতাহেতু লোকসান করেছেন, কেউ দেশের বা বিদেশের কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবসায় ক্ষতির শিকার হয়ে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন আবার কেউবা এক ব্যবসা থেকে টাকা অন্য ব্যবসায়ে টাকা সরিয়ে বিপাকে পড়ে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারেননি। অনেকক্ষেত্রে ব্যাংকের অদক্ষতা ও ব্যাংকের কাস্টমার ব্যবস্থাপনা-দক্ষতা অভাবের কারণেও ঋণ খেলাপি হয়। আবার ঋণগ্রহীতার সামান্য বিপদে ব্যাংক পাশে না থাকার কারণেও ঋণ খেলাপি হয়, ব্যাংক যখন বিপদগ্রস্থ ঋণগ্রহীতাকে কাছে টেনে নিয়ে নিজের পার্টনার ভেবে সাহায্য করে না তখন অনেক ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতে বিতরণকৃত ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আইএমএফের মতে, ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা সত্যিই উদ্বেগজনক। খেলাপি ঋণ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মূলধন ঘাটতি বাড়ে। কয়েকটি ব্যাংক মূলধনের ঘাটতির সমস্যায় পড়েছে। সেপ্টেম্বর ২০১৯ শেষে, ১২টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১৬ হাজার ৬০ কোটি টাকা। এছাড়া শ্রেণিবদ্ধ ঋণের বৃদ্ধি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে আরও চাপ তৈরি করছে এবং যদি পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে কিছু মৃতপ্রায় হয়ে পড়বে।
ভালোভাবে তদন্ত করলে দেখা যাবে উল্লিখিত যেসব ঋণ খেলাপি হয়েছে তার সিংহভাগ স্বেচ্ছা খেলাপি। এখন তাদের শ্রেণীবিভাজন করলে তাদের কোন দলে ফেলবেন তা এদেশের মানুষকে ঠিক করতে হবে। তারা কি আতিয়ার চোরের গোত্রভুক্ত যাকে সামান্য ভাত-তরকারী চুরির অপরাধে গাছে উলটো করে ঝুলিয়ে অমানবিকভাবে পেটানো হয়েছিল? তারা কি ডাকাত যারা জোর করে আপনার স্বর্ণালঙ্কার টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয় নাকি তারা বড় লুটেরা, দেশের শত্রু যারা দেশটাকে পঙ্গু করে, লুটের চারণভূমি বানিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে এদেশটাকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নরক করে তুলেছে?
ঋণ খেলাপিদের চরিত্র নির্ণয় ও অনুধাবন জরুরি। তাদের ভালোভাবে চিনতে পারলে এবং জনগণ তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে পারলে তাদের ধরা সহজ হবে, তাদের আইনের আওতায় আনা সহজ হবে, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমে আসবে এবং দেশ একটা শক্তিশালী ব্যাংকিং খাত পাবে। তবে সর্বাগ্রে যেটা দরকার সেটা হল সামাজিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতা। যদি দুষ্টের দমন করা না যায় তাহলে দেশ কখনো আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হবে না।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক