উদারপন্থী নারীবাদ যেভাবে নারীদের ব্যর্থ করে দেয়

উদারপন্থী নারীবাদী হওয়া খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কোনো কিছুই পাল্টাতে হবে না, মর্যাদাকে চ্যালেঞ্জ জানানোও আবশ্যক নয় এবং পুরুষকে দোষারোপ করারও বালাই নেই। অন্যভাবে বললে, সবকিছু আগের মতোই থাকছে এবং ব্যক্তিস্বতন্ত্রের আলোকিত হওয়ার অন্বেষণ ও উদারতা হয়ে উঠছে চাবিকাঠি।
নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের (সেকেন্ড ওয়েভ) সবচেয়ে পরিচিত স্লোগানগুলোর একটি- 'শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার' ('মাই বডি, মাই চয়েস')। এর কারণ, নারীদের উদারপন্থী আন্দোলনের অনেক সাফল্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নারীর জীবনযাপনে চয়েস বা পছন্দ বাছাইয়ের অনুপস্থিতিকে সামনে আনা হয়েছে। বিয়ে কিংবা সন্তানের ব্যাপারে, কিংবা এমনকি যৌনচর্চা ও পুলকের ব্যাপারে নারীদের কথা বলার সুযোগ ছিল সামান্য কিংবা একেবারেই ছিল না। নারীদের পছন্দ বাছাইয়ের চর্চাকে প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে নারীবাদ একটি ল্যান্ডস্কেপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে, 'চয়েসে'র কনসেপ্টটির সঙ্গে উদারনীতির বিষয়টি যুক্ত হওয়া মানে পুরুষের জন্য সুবিধাজনক ক্ষতিকর চর্চাগুলোকে মৌন স্বীকৃতি দেওয়া।
নিজেকেই প্রশ্ন করুন: পুরুষদের মতো নারীদেরও যদি নগ্ন বক্ষে (টপলেস) ঘোরা-ফেরা করা বৈধ হতো, তাহলে কী করতেন? গরমের দিনে রাস্তায় জনসমক্ষে নগ্ন বক্ষেই ঘুরতেন? কিংবা নগ্ন বক্ষে পার্কে বসে থাকার বাসনায় দোকানে ও-রকম পোশাক কিনতে ভিড় জমাতেন? যদি তা না করতেন, তার কারণ কী? আসলে নিউইয়র্ক সিটিতে নারীদের নগ্ন বক্ষে চলা-ফেরা আইনত বৈধ হলেও কেউ এ চর্চা করেন না।
'ফ্রি দ্য নিপল (এফটিএন) ক্যাম্পেইন'-এর কথাই ধরা যাক, যেটিকে স্লাটওয়াকে ফালতু 'নারীবাদী' আইডিয়া হিসেবে গণ্য করা যায়। পুরুষরা রাস্তায় বুক খোলা রেখে ঘুরলে কোনো বিড়ম্বনার শিকার না হলেও নারীদের সেই স্বাধীনতা নেই- এটির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ২০১২ সালে এফটিএন শুরু করেছিলেন ফিল্মমেকার লিনা এস্কো।
নারীদের ও মেয়েদের পোশাক-আশাক ও তাদের জীবনযাপনের বাস্তবতা সামনে এলে উদারপন্থী নারীবাদের সমর্থনে চয়েস ও সমতার ধারণাগুলোর ফল ভয়াবহ রকমের অবজ্ঞার হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন, এই মানবাধিকার লঙ্ঘণকে বোঝাতে 'ফিমেল' টার্মটি ব্যবহার করায় 'ফিমেল জেনাইটাল মিউটিলেশন' (এফজিএম) বিরোধী প্রচারণাকারীদের আমি নিজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্থা হতে দেখেছি। যৌনাঙ্গ শুধুই নারীদের- দৃশ্যত এই ট্রান্সফোবিকেরই ইঙ্গিত দেয় এটি।

অসহনীরকমের উঁচু জুতো কেনা, শরীরচর্চার অংশ হিসেবে পোল-ড্যান্স করা, স্তন বর্ধনকারী অস্ত্রোপচার, ইনস্টাগ্রামে নগ্ন ছবি পোস্ট করা এবং 'যৌনকর্মী': এসব বিবেচনায় নারীর ক্ষমতায়নের শ্রেণিবিন্যাস করা হচ্ছে আজকাল। কিন্তু এইসব নতমস্তক চর্চাগুলোর মধ্যে মিল কোথায়? এ সবকিছুই পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। আর এ সবকিছুরই সমর্থন করেন উদারপন্থী নারীবাদীরা।
সমকালীন এক উদাহরণ টানা যাক: লন্ডনে সম্প্রতি ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফটের একটি ভাস্কর্য করা হয়েছে, যেটিতে মোচড়ানো অসংখ্য নগ্ন দেহের ওপর নগ্ন এক নারী দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে মনে হয়। যৌন-উদারতা হিসেবে এটিকে গণ্য করে উদারপন্থী নারীবাদীরা হয়তো খুশি এবং তারা হয়তো একটি বিষয় এড়িয়ে যেতেই চান: পুরুষদের বেশিরভাগ ভাস্কর্যেই পোশাক পরিহিত দেখা যায়, এবং নারীদের ভাস্কর্যগুলোর ক্ষেত্রে প্রতি আড়াইটির মধ্যে মাত্র একটিতে দেখা মেলে পোশাকের। আমার কাছে ওই (ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফটের) ভাস্কর্যকে মনে হয়েছে যেন সাজানো কোনো ক্রিসমাস ট্রি; মোটেও ভালো লাগেনি দেখতে।
তবে কিছু বিষয়ে উদারপন্থী নারীবাদীদের জাহির করা ইচ্ছেকৃত ভুল ব্যাখ্যার ব্যাপারেও জরুরি আলাপ তোলা দরকার; উদাহরণ হিসেবে বৈশ্বিক যৌন-বাণিজ্যের ভয়াবহ রূপের কথাই ধরুন। পতিতাবৃত্তি, কিংবা উদারপন্থী নারীবাদীরা যাকে 'সেক্স ওয়ার্ক' বলে ডাকেন, এটি নারী নিপীড়নের একটি কারণ ও পরিণাম। কিন্তু উদারপন্থীরা তা মনে করেন না! এখন পর্যন্ত অন্তত অল্প কিছু নারী হলেও পুরুষের একপাক্ষিক যৌন-পুলকের জন্য 'শরীর ভাড়া' দেওয়াকে বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ ও স্ত্রীবিদ্বেষের মতো সামাজিক কাঠামোগুলোতে 'ক্ষমতায়ন' হিসেবে বর্ণনা করছেন, যা কি না বৈশ্বিক পতিতাবৃত্তিকে এড়িয়ে যাওয়ারই সমার্থক।
ট্রান্সজেন্ডার নারীদের নারী হিসেবে গণ্য করা হবে কি না, সেই তীক্ষ্ণ ইস্যুর বেলায়ও একই কথা খাটে। উদারপন্থী নারীবাদীরা তাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নের বিবেচনায় এবং শিক্ষার মাধ্যমে পাওয়া তুলনামূলক শ্রেয় মানসিকতার ওপর ভিত্তি করে ভাবেন, তাদের কখনোই কোনো কারাগারে কিংবা সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ডে যেতে হবে না। হয়তো মনে রাখা ভালো, উদারপন্থী নারীবাদীরা প্রায় বরাবরই মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্তের মানুষ; তারা ধরে নেন, পারিবারিক সহিংসতার কোনো আশ্রয় কেন্দ্রের সেবা তাদের জন্য দরকার পড়বে না।
অংশত এক্সট্রিম ট্রান্সজেন্ডার আইডিওলজিকে উদারপন্থী সমর্থন দেওয়ার ফলে পুরুষের সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সরাসরি সহযোগিতা দিতে বেশ কিছু 'শুধুই নারীদের জন্য' ('ফিমেল অনলি') সেবা কার্যক্রম চালু হয়েছে, যারা সহসা স্বীকার করতে চায় না, ট্রান্স-ওম্যানের মধ্যে পুরুষ দেহও থাকে। উদারপন্থীরা সাফল্যের সঙ্গে আওয়াজ তোলেন, ট্রান্স-ওম্যানকে নারীদের অংশেই রাখতে হবে, যদি তারা যৌন নিপীড়ক হয়, তবু।
'ফিমেল অনলি' ক্লাব ও স্পোর্টিং ফ্যাসিলিটিগুলোও পড়েছে হুমকিতে। যেমন ধরুন, বিশ্বব্যাপী 'গার্লগাইডিং' আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লেও, এটির একটি নীতি রয়েছে: নিজের প্রেমিকা কিংবা বাবা-মা না বলুক, তবু নিজেকে মেয়ে মনে করা ছেলেরাও এটির সব ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারে। শিশুদের নিয়ে কাজ করা অ্যাডাল্ট ভলান্টিয়ারস ওয়ার্কিং ও ওভারনাইট ক্যাম্পগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
উদারপন্থী নারীবাদীরা নিপীড়ক পুরুষদের এতই ভয় পান, যে, নিজেদের মর্যাদা ধরে রাখতে তারা পেছনে বেঁকে যান, যা কি না নারীদের জন্য যথাযোগ্য উদারনৈতিকতা অন্বেষণের ঠিক উল্টো প্রবণতা। কুঠার হাতে কুচি কুচি করে কেটে ফেলার বদলে তারা বরং টেবিলের এক কোণায় বসে তাদের মুখে সামান্য খাবার ছুড়ে আসার ভেতরই আনন্দ পান। কোনো সুনির্দিষ্ট ধরনের নারীবাদকে যদি পুরুষেরা সমর্থন করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, সেটির কোনো কার্যকারিতা নেই। নারীবাদের তো বরং পুরুষের জন্য একটি হুমকি হয়ে ওঠা উচিত; কেননা, জন্মগতভাবে স্রেফ একটি পুরুষাঙ্গের অধিকারী হওয়ায় ছড়ি ঘোরানো পুরুষতন্ত্র থেকেই তো মুক্তি খুঁজছি আমরা।
নারীদের নগ্ন ভাস্কর্য নারীবাদের কাজেও আসবে না, নারীবাদকে হোঁচটও খাওয়াবে না। নারীদের জন্য আমাদের যা দরকার, তা হলো, জেগে ওঠা ও সাহসী হওয়া; এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বিষয়-আশয় প্রত্যাখ্যান করা।
উদারপন্থী নারীবাদীদের সংস্কার হওয়া দরকার।
- লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও নারীবাদ প্রচারক; যুক্তরাজ্য; তার লেখা বই 'ফেমিনিজম ফর উইমেন: দ্য রিয়েল রুট টু লিবারেশন' প্রকাশ পাবে ২০২১ সালের মে মাসে
- আল জাজিরা থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ