আসুন আনন্দীকে নিয়ে আনন্দে বাঁচি
"যখন তুমি প্রাণ থেকে, আত্মা থেকে কোনো কাজ করো, তখন তুমি অনুভব করবে একটি নদী তোমার ভেতরে তিরতির করে বইতে শুরু করেছে। সেই নদীর নাম আনন্দ" -- কথাগুলো বলেছেন মওলানা জালালউদ্দীন রুমি। রুমি ১৩শ শতাব্দীর একজন ফার্সি মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ধর্মবেত্তা, এবং সুফী ছিলেন। রুমির সেই আনন্দ নদী দিয়েই এই লেখার শুরু।
সালমা-রিয়াজের বিয়ের ১০ বছর পরেও যখন কোলে কোন শিশু এলো না, তখন তারা অনাথ আশ্রম থেকে ৫ মাসের একটি মেয়েশিশুকে নিয়ে এসেছিলেন। পরিবারের কারোরই এতে প্রথমে মত ছিলনা। কিন্তু তারা দুজনে দৃঢ়ভাবে সমাজকে মোকাবিলা করে মেয়েটিকে মানুষ করেছেন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এবং বিয়েও দিয়েছেন। মেয়েটির নাম আনন্দী। আনন্দীকে দেখলে মনটা খুশিতে ভরে উঠে। একটা পরিচয় আর বুকভরা ভালবাসা মেয়েটির জীবনকে একদম বদলে দিয়েছে।
আনন্দীর কথা মনে হতেই, মনেহল "ছোটমণি নিবাস" এর কথা। আমরা যারা ছোটমণি নিবাসের সাথে পরিচিত, নামটা শুনলেই তাদের মনে একটা মায়া জন্ম নেয়। সাধারণত নবজাতক থেকে ৭/৮ বছর বয়স পর্যন্ত ২৫/৩০ টা শিশু এখানে থাকে। এই শিশুগুলোর কোন পরিচয় নেই, নেই বাবা-মা। এদের কাউকে কুড়িয়ে পেয়েছে ড্রেনে, কাউকে বাগানে, কাউকে মা ইচ্ছে করেই ফেলে গেছেন হাসপাতালে বা বাজারে। এরপর মায়াময় এই শিশুগুলোর ঠাঁই হয়েছে এই সরকারি নিবাসে।
কেউ যখন ওদের জন্য ভালবেসে চকলেট, মিষ্টি, কেক, বিস্কুট, বেলুন, রং পেন্সিল বা অন্য কোনকিছু নিয়ে যায়, বাচ্চাগুলো তখন হাসতে হাসতে ছুটে আসে। ওরা জানে ওদের জন্য নিয়ে এসেছে ভালবাসার পসরা। এত সামান্য জিনিস কিন্তু ওদের আনন্দ সীমাহীন। এসে সালাম দেয়, এরপর লাইন ধরে বসে যায় খাবার নেয়ার জন্য। কোন কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি নেই, নেই চিৎকার চেঁচামেঁচি। যে যা দেয়, ওরা আনন্দে আপ্লুত হয়ে তাই ভাগ করে খায়। পোলাও-কোর্মা, রোষ্ট দিলেও খুব খুশি হয়। তবে এর চেয়েও বেশি খুশি হয় শিশুদের প্রিয় জিনিসগুলো পেলে।
সেখানে সাজিয়ে রাখা ছোট ছোট বিছানাগুলো দেখলে মনেহয় যেন ঘুমন্ত রাজকন্যার বন্ধু সেই সাত বামণের ঘর। দু'চারটি বাচ্চা থাকে একেবারে নবজাতক। বাচ্চাদের মধ্যে কেউ থাকে অসুস্থ, কেউ জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী। যে শিশুকে তার বাবা মা পথে ফেলে চলে যায়, সেই শিশুর মত অভাগা আর কেউ আছে কিনা, আমার জানা নেই।
বাচ্চাগুলোকে দেখে ভাবি আমরা আমাদের বাচ্চাদের কত আদর-ভালবাসা, কঠোর নিরাপত্তা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস, থালা ভর্তি খাবার দিয়ে বড় করার চেষ্টা করি। অথচ এই শিশুগুলোর কিচ্ছু নেই। শুধু মানুষের ভালবাসার উপর বেঁচে আছে।
কিছু মানুষ তাদের ইন্দ্রিয়কে ক্ষণকালের সুখ দেয়ার জন্য যে ভোগ করে, মূলত তা একধরণের অপরাধ। সেই অপরাধের ভার বহন করে বড় হতে হয় এই শিশুগুলোকে। অবশ্য অনেক সময় নারী শারীরিক নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়ে অনাকাংখিত গর্ভধারণ করে এবং বাধ্য হয় বাচ্চাগুলোকে ফেলে যেতে। দু'একটি বাচ্চা কোনভাবে হারিয়ে গিয়ে এখানে আশ্রয় পায়।
একদিন খাওয়া দাওয়া শেষে চলে আসার সময় ৪/৫ বছরের একটি শিশু আমার জামা ধরে টেনে বারবার বলতে লাগলো তোমার সাথে আমাকে নিয়ে যাও। আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে যেতে চাই। কিছুতেই সে আমাকে ছাড়বেনা। ওকে দেখে চোখে পানি এসে গেল। আয়ারা বলল, ছেলেটিকে বাজারে পেয়েছে পুলিশ। হয়তো হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজেও অভিভাবক না পেয়ে এখানে রেখে গেছে।
আমি ছবি তুলে নিয়ে এসে প্রথম আলো, ডেইলি স্টারে দিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ ওর খোঁজ নেয়নি। হয়তো ওর বাবা মা পত্রিকাই পড়েন না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে কষ্টে কিংবা ভয়ে আমি আর উপরে যাইনা। শুধু উপহার পৌঁছে দিয়ে পালিয়ে আসি। অনাথ বাচ্চাদের কান্নার কষ্ট সহ্য করা খুব কঠিন।
ওদের জন্য, কিছু যে করতে পারিনা এই কষ্ট কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এর ঠিক উল্টোদিকে যখন দেখি অসংখ্য দম্পতি একটি সন্তানের মুখ দেখার জন্য চিকিৎসা করে লাখ লাখ টাকা খরচ করছেন, দোয়া পড়ছেন, কাঁদছেন, মানুষের কাছে আজেবাজে মন্তব্য শুনছেন। প্রকৃতির কী অদ্ভুত বৈসাদৃশ্য। ছোট ছোট শিশুরা পরিচয়হীন বড় হচ্ছে, আর দম্পতিরা মা বাবা ডাক শোনার জন্য চোখের পানি ফেলছেন।
মাসখানেক আগে সকালে খবরে দেখলাম একটি শিশুকে বিমানবন্দরে ফেলে চলে গেছেন কেউ একজন। শিশুটির কোন নাম পরিচয় নেই। মনে করা হচ্ছে সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা কোন মা বাচ্চাটিকে ফেলে গেছেন। গত কয়েক বছরে আমরা হাজারো অভিবাসী নারীর খবর দেখেছি, যারা ভয়াবহ কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করে দেশে ফিরে এসেছেন।
এর মধ্যে এমন ১০টি ঘটনার কথা ব্র্যাক জানিয়েছে, যেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে এই শিশুদের জন্ম হয়। এর কিছুদিন আগে ওমান থেকেও ফেরত আসা এমন এক মা ও শিশুকে পাওয়া গেছে। মেয়েটির পরিবার সেই মা ও তার শিশুকে গ্রামে নিতে পারেনি লোকলজ্জার ভয়ে। পরে আশ্রয় হয়েছে গাজীপুরের একটা কেন্দ্রে।
খবরটা দেখে মনে হল, বাংলাদেশ সরকার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী শ্রমিক, বিশেষ করে নারী গৃহশ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি কেন গুরুত্বের সাথে ভাবছে না? এত অভিযোগ, এত অত্যাচার, এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে খবর হয়ে আসছে কিন্তু সরকার নির্বিকার। মানুষগুলো দরিদ্র ও অসহায় বলে? নাকি এদের হয়রানির মাধ্যমে পুরুষ শ্রমিকদের অভিবাসনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলে? যতবার নারী গৃহশ্রমিকদের হয়রানির খবর দেখছি, ততোবার এই প্রশ্নগুলো আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। যাক পরে এ প্রসঙ্গে আবার কথা বলা যাবে।
বিমানবন্দরে শিশুটিকে পাওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ামাত্র আমার পরিচিত ২/৩ জন মেয়েটির অভিভাকত্ব নেয়ার জন্য ফোন করেছেন, খোঁজ চেয়েছেন। পুলিশ সম্ভবত হাসপাতাল হয়ে শিশুটিকে সেই ছোটমণি নিবাসেই নিয়ে আসবে বলে শুনেছি। হয়তো এতদিনে চলেও এসেছে। অসংখ্য দম্পতি ইতোমধ্যেই বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছেন।
ছোটমণি নিবাসসহ আরো কয়েকটি কেন্দ্রে এই অনাহুত শিশু অতিথিদের রাখা হয়। পরিচয়হীন একজন শিশুর এই সমাজে বেঁচে থাকাটা কতটা ভয়াবহ হওয়ার কথা, তা সহজেই অনুমেয়। যে মায়ের কোল শিশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয়, সেই মা-ই যখন, সমাজের ভয়ে সন্তানকে বুকে তুলে নিতে পারেন না, তখন বুঝতে হবে সেই শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার এই সমাজ, রাষ্ট্র ভূলুন্ঠিত করছে।
কাজেই আমরা প্রত্যাশা করবো এইসব অনাথ শিশুকে আইনগত অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করার পদ্ধতি আরো সহজ করা হোক। প্রতিটি সন্তানহীন মায়ের বুকে যেন একজন শিশু আশ্রয় পায়, শিশুটি বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো শক্ত মাটি পায়। সমাজ যেন তাকে জন্ম পরিচয়হীন "বেজন্মা" বলে আঙ্গুল দেখাতে না পারে।
অন্যদিকে যারা সন্তানহীন দম্পতি, তারা একটি শিশুকে বুকে তুলে নিয়ে যেমন নিজেদের একাকীত্ব ঘোচাতে পারেন, তেমনি শিশুর হাতে একটি পরিচয় তুলে দিয়ে, মায়া, মমতা ও ভালবাসা দিয়ে বড় করে তুলতে পারেন। সমাজের মানুষ হয়তো অনেক কটুক্তি করতে পারে, কিন্তু এইসবকে অগ্রাহ্য আমাদের এমন এক পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে, যেখানে বাবা-মা পাবেন সন্তান, সন্তান পাবে মা-বাবার আদর, ভালবাসা। আর আমাদের মনের "আনন্দ" নামের নদীটা তিরতির করে বয়ে যাবে।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন