জার্মানিতে আবারও কোনো কোয়ালিশন ক্ষমতায় আসবে, তবে মের্কেলকে মনে রাখবে বিশ্ব
জার্মান সাধারণ নির্বাচনে চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) এর চেয়ে এগিয়ে আছে বামপন্থি দল, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি)। ২০০৫ সাল থেকে ১৬ বছর ধরে মের্কেলের অধীনে চলা রক্ষণশীল শাসনের অবসান হতে চলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসপিডি প্রায় ২ শতাংশ ভোটে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন সিডিইউ দলের মুখপাত্র মনে করেন, তার দল এখনো সরকার গঠনে সক্ষম। ২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের তুলনায় এবারে নির্বাচনে এগিয়ে থাকা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) ভোট বেড়েছে ৪ শতাংশ। ওখানকার সবুজ দলের সমর্থন বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। অপরদিকে ক্ষমতায় থাকা ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) ভোট কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর (১৯৪৯ সাল) হতে জার্মানিতে ঘুরে ফিরে জোটবদ্ধ সরকার ব্যবস্থা। জার্মানিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা জোটবদ্ধ হয়ে সরকারে থাকে। এটা এখন জার্মানির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ নির্বাচনের পর মের্কেলের নেতৃত্বে ৪ দলীয় জোট সরকারে প্রধান দুই শরিক দল এবারের নির্বাচনে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। চার বছর ক্ষমতায় থাকা দুই শরিক কেন বিছিন্ন হলো তা গোপনীয়তার দায়বদ্ধতার কারণে জানা সম্ভব হয়নি।
৮ কোটির দেশ জার্মানে এবারের ভোটার ৬ কোটি ১৮ লাখ। ১৮ বছর বয়সী সকল নাগরিক ওখানকার ভোটার। ৩০ লাখ নতুন ভোটার এবার প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্য থাকলে যেকোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। জার্মান সংবিধান অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দলকে সংসদে যেতে হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ভোটারের কমপক্ষে ৫ শতাংশের সমর্থন পেতে হবে। এই ৫ শতাংশের বেড়াজালের কারণে এবারের (সদ্য সাবেক) সংসদে মাত্র ৬টি দল অংশ নিতে পেরেছিল। এবারেও ৪২টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
প্রতিটি ভোটার যথারীতি দুটি করে ব্যালট নিয়ে একটি তার পছন্দের প্রার্থীকে এবং অন্যটিতে পছন্দের দলকে ভোট দিয়ে থাকেন। রাজনৈতিক দলগুলো প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী সংসদ সদস্য মনোনীত করে সংসদে পাঠাতে পারবে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগেই এই প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রকাশ করে রাখে। প্রাপ্ত ভোট বিশ্লেষণ করে ঐ তালিকার ক্রম অনুযায়ী রাজনৈতিক দল সংসদ সদস্য চূড়ান্ত করে পার্লামেন্টে পাঠায়। পার্লামেন্ট আসনের অর্ধেক আসে রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে আর বাকি অর্ধেক আসে সরাসরি ভোটারের ভোট প্রদানের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে অন্যান্য অসুবিধার পাশাপাশি সংসদের আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট রাখা সম্ভব হয় না।
কোনো দলের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসা সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হয় দলীয়ভাবে মনোনীত সংসদ সদস্যরা। দলীয়ভাবে মনোনীত সদস্যের সংখ্যা কত হবে তা বলা যায় কেবল প্রদত্ত ভোট বিশ্লেষণের পর। সে কারণে পার্লামেন্টে কতটা আসন থাকবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ২৯৯ টি সংসদীয় আসনে এবারও সরাসরি ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ২৯৯ জনের সাথে যুক্ত হবেন দলীয়ভাবে আসা সংসদ সদস্যগণ। এভাবেই জার্মানিতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দল সমভাবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে।
এবারের নির্বাচনের আগে জোটগত সমঝোতা না হওয়ায় জার্মান প্রেসিডেন্ট হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের সাথে তুলনা করেছেন। সমঝোতার উপায়গুলো নিয়ে আবারো ভাবতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করেছেন। ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত করে। মিত্র দেশগুলো দেশটিকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে। ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন ও সোভিয়েত সেনারা একেকটি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমা শক্তিগুলির মধ্যকার মিত্রতা ১৯৪০-এর দশকের শেষে ভেঙে গেলে সোভিয়েত অঞ্চলটি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তথা পূর্ব জার্মানিতে পরিণত হয়। পশ্চিম-নিয়ন্ত্রিত বাকি তিন অঞ্চল একত্রিত হয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করে। সেই জার্মান এখন বিশ্বের একটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। এটির অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , চীন ও জাপানের পরে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম। জার্মানি লোহা, ইস্পাত, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম এবং মোটরগাড়ি রপ্তানি করে। জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি।
১৯৫৪ সালের ১৭ জুলাই পশ্চিম জার্মানির হ্যামবুর্গে অ্যাঙ্গেলা মের্কেল জন্মগ্রহণ করেন। এরপর তিনি লাইপৎসিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞান পড়েন। পরবর্তীকালে মের্কেল বার্লিনে অবস্থিত জার্মান বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিতে ভৌত রসায়ন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নেন এবং এখানেই তার কর্মজীবন শুরু করেন। কোয়ান্টাম রসায়নের উপর গবেষণার জন্য তাকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এরপর তিনি এখানে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। বার্লিনে থাকতে বাধ্যতামূলক মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ কোর্সে মের্কেল পাশ করলেও ফলাফল খুব একটা ভালো ছিল না।
অ্যাঙ্গেলা মের্কেল তার দল, দেশ ও জনগণের কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। নারী ভোটার তো বটেই পুরুষ ভোটাদের কাছেও সমান জনপ্রিয়। স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে বলেছেন, নুতন কেউ আসুক। দল ও দেশকে নেতৃত্ব দিক। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা আরও এগিয়ে নিক। স্বল্পতম সময়ে করোনা নিয়ন্ত্রণসহ জার্মান পুঁজির বিস্তার, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় ক্রয়সক্ষমতা বৃদ্ধি এমন জায়গায় নিয়েছেন, অন্য কোনো দেশ তার ধারে কাছে নেই।
ইউরোপীয় ঐক্য ধরে রাখা, ইউরো'র প্রসার ও বাজার ধরে রাখতে মের্কেল বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে তার নিজের দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন পরিবেশ বান্ধব পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। যদিও জার্মানের ৭০ শতাংশ ভোটার মনে করেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল সমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। আবারও কোনো কোয়ালিশন জার্মান ক্ষমতায় আসবে এবং মের্কেলের আশাবাদ অনুযায়ী দেশের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। কোনো বৈষম্য থাকলে সেটাও দূর হবে, কিন্তু থাকবেন না অ্যাঙ্গেলা মের্কেল।
বিদায় তাকে জানাতেই হচ্ছে।
-
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক