আবারও এক অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি পাকিস্তান
পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) ও সরকার মুখোমুখি অবস্থানে। ফ্রান্সে মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হওয়ায় সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে আসছে টিএলপি। গত বছরের শেষের দিকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে সহিংস রূপ পেতে থাকে। থানা আক্রমণ, পুলিশ অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা ঘটতে থাকে। দেশটির প্রধান কয়েকটি শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে টিএলপি–সমর্থকদের সংঘর্ষ ঘটে। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।
ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফরাসি রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই "মুক্তি, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব" ফরাসী রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রকে রক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতা - ফরাসি ভাষায় যাকে বলে 'লাইসিত'। লাইসিতের মূল কথা হলো, জনসমক্ষে - তা ক্লাসরুম হোক বা কাজের জায়গায় হোক - কোথাও ধর্মের কোনো কথাই চলবে না।
ফরাসী রাষ্ট্রের কথা - কোনো একটি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিকে রক্ষার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধি-নিষেধ চাপালে 'জাতীয় ঐক্য' বিনষ্ট হবে। ক্লাসে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আলোচনায় শিক্ষকদের বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্রের ব্যবহার সেখানে সাধারণ বিষয়। খ্রিস্টান প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও ফ্রান্সে যিশুখ্রিস্টের ব্যঙ্গচিত্র ব্যবহার হয় প্রতিনিয়ত। যে কারণে ফ্রান্স ধর্ম নিরপেক্ষতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশ্বে সকলের উপরে অবস্থান করে।
চলতি বছরের এপ্রিলে লাহোরে এক সমাবেশে টিএলপি–প্রধান আল্লামা সাদ হুসাইন রিজভি 'আইন হাতে তুলে নেওয়ার' হুমকি দিয়ে বলেন, প্রয়োজনে চুড়ান্ত উগ্রপন্থা অবলম্বন করে হলেও ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে। এরপরই সরকার লাহোর থেকে সাদ হুসাইন রিজভিকে গ্রেপ্তার করে।
পাকিস্তানে সদ্য পাস হওয়া সন্ত্রাস বিরোধী আইনের আওতায় টিএলপিকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং টিএলপি ইসলামিক উগ্রপন্থী দল হিসেবে নিষিদ্ধ হয়। সাদ হুসাইন রিজভির গ্রেপ্তারের পর থেকেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের বহিষ্কারের দাবির সাথে এখন যুক্ত হয়েছে, টিএলপি প্রধান রিজভর মুক্তি এবং টিএলপির নিষিদ্ধ ঘোষণা প্রত্যাহার। নিষিদ্ধ হওয়ার পরও দলটি লাহোর থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখি 'লং মার্চ' পরিচালনা করছে।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, টিএলপির এ দাবি ঝুঁকিপূর্ণ, যা বাইরের বিশ্বে পাকিস্তানকে 'উগ্রবাদী জাতি' হিসেবে তুলে ধরছে। তবে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন সরকার কীভাবে মোকাবেলা করবে বা কৌশল কী হবে তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রাশিদ আহমেদ স্পষ্ট করেননি।
পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিকাশ নুতন কিছু নয়। অনেকে বলছেন, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল, পাকিস্তানে 'ঘাপটি' মেরে থাকা উগ্রবাদীদের উৎসাহিত করছে। তারা নতুন উদ্যোমে সংগঠিত হয়ে আফগানিস্তানের ন্যায় ক্ষমতা দখলের পর ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষিত রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ ইসলামী শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। তালেবানদের আফগান দখল এবং সেখানকার সরকার গঠন নিয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা সবাই দেখেছে।
আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টায় পাকিস্তান অঙ্গীকারাবদ্ধ। ফলে পাকিস্তানের মাটিতে বসে,'পাকিস্তান হবে আফগান' এই স্বপ্ন দেখা খুব একটা দোষের হবে না। পাকিস্তান নিয়ে এই বিশ্লেষণ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কেননা ধর্মীয় উগ্রবাদ চর্চার সকল উপাদান পাকিস্তানে রয়েছে। এমন কি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের অভিযোগও আছে। আল-কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের জীবিত শেষ আশ্রয়স্থল ছিল পাকিস্তানেই। একটা লম্বা সময় তিনি সেখানে আত্মগোপনে ছিলেন। ইত্যাদি আরো নানাবিধ কারণে বর্হিবিশ্বে পাকিস্তানের ইমেজ সংকট তীব্র। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের প্রশ্রয়দানকারী রাষ্ট্র হিসেবে একটা পরিচিতি দাঁড়িয়ে গেছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের সংসদের যৌথ অধিবেশনে সন্ত্রাসবিরোধী এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থ যোগান বিরোধী দুটি বিল পাস হয়। এই বিল দুইটি আপাত দৃষ্টিতে প্যারিস ভিত্তিক ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স এফএটিএফ'এর 'ধূসর' তালিকা থেকে অব্যাহতির জন্য পাকিস্তানের প্রচেষ্টা।
বিশেষভাবে আহ্বান করা সংসদের একটি যৌথ অধিবেশনে ওই বিলগুলি পাসের জন্য পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং বিল দুইটি পাস করতে সফল হয়। এর আগে অনেকবার চেষ্টা করেও উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিল পাস করা সম্ভব হয় নি। উল্লেখ্য, সন্ত্রাসে অর্থ যোগানের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে পাকিস্তানের অনীহার প্রেক্ষিতে আর্থিক নজরদারি সংস্থা – এফএটিএফ ২০১৮ সালের জুন মাসে পাকিস্তানকে "ধূসর" তালিকাভুক্ত করে।
বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হতে অর্থ সহায়তা বা ঋণ পাওয়ার অনেকগুলো শর্তের মধ্যে অন্যতম, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ভূমিকা। সেদিক বিবেচনায় ধূসর তালিকায় থাকার ফলে পাকিস্তান বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বিশ্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারছে না। এর ফলে ইতোমধ্যেই পাকিস্তান আর্থিকভাবে দেউলিয়া রাষ্ট্রে উপনিত হয়েছে। ইসলামাবাদ যদি এবারেও এফএটিএফকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত হতে হবে। তাহলে এমন সব বিধি-নিষেধের সম্মুখীন হতে হবে যা মোকাবিলা করা পাকিস্তানের পক্ষে অসম্ভব বলে ধারণা অনেকের।
সংকট মোকাবেলায় পাকিস্তানের সামনে খুব বেশি পথ খোলা নেই। টিএলপি যে শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে তাতে পাকিস্তান তার সদ্য পাস হওয়া সন্ত্রাস বিরোধী আইনের প্রয়োগ ও বাস্তাবায়ন করতে পারবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমারা তাদের নিজস্ব প্রয়োজনেই বিশ্বের নানা প্রান্তে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদে মদত দিয়ে থাকে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়াসহ তাবৎ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ উষ্কে দেয় এবং 'সন্ত্রাস' নির্মূলের নামে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মিথ্যা অজুহাতে ইরাক দখলসহ সমগ্র অঞ্চলে অন্যায় যুদ্ধ অথবা যুদ্ধাবস্থা জারি রয়েছে প্রায় তিন দশকের অধিক সময় ধরে।
২০১৫ সালে জন্ম নেওয়া টিএলপির এই শক্তির উৎস কী তা অবশ্যই ভাবতে হবে। পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের বাস্তবায়নের ব্রত নিয়ে টিএলপি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে। পাঞ্জাবের প্রাক্তন গভর্নর সালমান তাসিরকে হত্যাকারী মুমতাজ কাদরীকে আদালতের রায়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর পর তার প্রতিবাদে টিএলপি প্রকাশ্যে আসে। গভর্নর সালমান তাসিরকে হত্যা করা হয়েছিল ব্ল্যাসফেমি আইনের বিরোধিতা করার জন্য। সম্প্রতি ব্লাসফেমি আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খ্রিস্টান নারী আসিয়া বিবি'র উচ্চ আদালত মুক্তি দিলে দেশব্যাপী বিক্ষোভ দেখায় টিএলপি। ধারণা করা হয় পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে টিএলপি'র পিছনে।
পাকিস্তানের এখন আর এক বিপদ চীনের সাথে তার বন্ধুত্ব। চীনের অর্থনৈতিক বিকাশ চেনা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। '৮০ দশকে স্নায়ু যুদ্ধের অবসানের পর হতে প্রায় ৪০ বছর সমগ্র পৃথিবীর মোড়লগিরির পরিবর্তন হতে চলেছে। চীনের অর্থনীতির বিস্ময়কর সাফল্য রুখে দিতে চেষ্টার অন্ত নেই।
অর্থনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তার নামে নানাধরনের মেরুকরণ চলছে। কোয়াড অথবা মার্কিন-ব্রিটেন-অস্ট্রেলিয়া অকাস চুক্তি, ভারত- চীন দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা, দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব, আফগান প্রশ্ন এসবই চীনকে চেপে ধরার চেষ্টা। চীনের সাথে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব পশ্চিমারা ভালভাবে নিবে না এটা ইসলামাবাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
পৃথিবীর প্রথম সারির গণমাধ্যম আমাদেরকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল, ইরাকের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে। সিরিয়ার আসাদ সরকার রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে—এই অজুহাতে দেশটির ওপর আমেরিকার ঝটিকা বিমান হামলার তৎপরতা রাশিয়ার পাল্টা হুমকির মুখে বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু এর আগে তারা রাশিয়ার আপত্তি উপেক্ষা করেই ইরাকে হামলা চালিয়েছে। তার আগে বিশ্বজনমতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আল-কায়েদা ও তালেবান নির্মূলে আফগানিস্তানে ব্যাপক বিধ্বংসী হামলা চালিয়ে সাধারণ আফগানদের আক্ষরিক অর্থেই সর্বনাশ করেছে।
ইরাকের ব্যাপারে তাদের অজুহাত ছিল সাদ্দাম হোসেনের ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, সেটা বিশ্ববাসীর নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছে, সাদ্দামের সে রকম কিছু ছিল না। পশ্চিমা শাসকদের নৈতিকতা ভয়ংকর স্ববিরোধিতায় ভরা। এই পশ্চিমা গণমাধ্যম এখন প্রচার চালাচ্ছে, চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
একই ধরনের প্রচারণা ছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে তালেবানদের মদত দিয়েছে ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার নামে। পাকিস্তানের আজকের পরিস্থিতি বিছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। সামগ্রিক বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকেই দেখতে হবে। এ রকম এক জটিল পরিস্থিতিতে পাকিস্তান এখন আবারও এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। পাকিস্তান কি পারবে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে নাকি আবারও ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা গায়ে লাগাবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।
-
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক