অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের শূন্যতা অনুভব করবে না বিশ্ব!

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থায় যা এক অন্ধকার যুগ ফিরে আসার নামান্তর। কট্টরপন্থী নেতৃত্বে শাসিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিট ঘিরে বিশৃঙ্খলা এবং আরেক বৃহৎ গণতন্ত্র ভারত এগিয়ে চলছিল স্বৈরচারী ব্যবস্থার দিকে। দিনে দিনে আরও দমনমূলক হয়ে উঠছিল চীন ও রাশিয়া। এ বাস্তবতায় জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলকেই মনে হচ্ছিল 'মুক্ত বিশ্বের নেতা'।
তিনি যখন জার্মানির শাসনভার কাঁধে তুলে নেন, তখন তাঁর সমকালীন আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ, টনি ব্লেয়ার, জ্যাক শিরাক ও সিলভিও বার্লুসকোনির মতো বিশ্ব নেতারা। ১৬ বছর নিজ দেশের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালনের পর, অবশেষে বিদায় নিচ্ছেন অ্যাঙ্গেলা ডরোথিয়া মের্কেল।
এ বিদায় পূর্বঘোষিত হলেও, তাঁর নায়কোচিত ভাবমূর্তির অনুপস্থিতি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। সবার উদ্বেগ: মের্কেল-পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে ট্রাম্পকরণের যুগ আসবে? আরও উদ্বেগ: বিশ্ব অঙ্গনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় দেশটির সোচ্চার ভূমিকা কি তবে অতীতে পরিণত হতে চলেছে?
কিন্তু এসব প্রশ্নের প্রেক্ষাপট ত্রুটিপূর্ণ ধারণার কাঠামোয় গঠিত। নিঃসন্দেহে মানবিক ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে মের্কেল তুমুল করতালি পাওয়ার যোগ্য; কিন্তু তার মানে এ নয় যে, সভ্যতা ও বর্বরতার মাঝখানে তিনিই শেষ রক্ষাকবচ ছিলেন। মের্কেল বিদায় নিলেও জার্মানি উদারপন্থীদের দ্বারাই শাসিত হবে, এমন সম্ভাবনাই বেশি।
মের্কেল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার নিয়ে যত্নশীল হলেও, ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি এসব রক্ষায় অমূল্য কোনো অবদান রাখতে পারেননি। তাঁর উত্তরসূরীর অধীনেও জার্মানি হয়তো উদারনৈতিক নীতির পক্ষে বিবৃতি দেবে; কিন্তু বাস্তবে তার খুব কমই কাজেকর্মে প্রতিফলিত হতে পারে, মের্কেল যুগের মতোই।
সমাজবিজ্ঞানীরা পরিসংখ্যান মডেলের ভিত্তিতে কোনো বিশেষ পরিস্থিতির সম্ভাব্য ফলাফল জানার চেষ্টা করেন।
বিশেষ কিছু শর্তের গাণিতিক সংকেতের অধীনে তারা বারবার একটি সরল মডেল পুনরাবৃত্তি করে বোঝার চেষ্টা করেন বাস্তবে একটা ঘটনা কতবার ঘটার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কোনো সমাজবিজ্ঞানী যদি মের্কেলের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতেন, তাহলে দেখতে পেতেন—তিনি যে বলিষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন গাণিতিক মডেলে তাঁর সম্ভাবনা দশ লাখে একবার।
মের্কেল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার নিয়ে যত্নশীল হলেও, ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি এসব রক্ষায় অমূল্য কোনো অবদান রাখতে পারেননি। তাঁর উত্তরসূরীর অধীনেও জার্মানি হয়তো উদারনৈতিক নীতির পক্ষে বিবৃতি দেবে; কিন্তু বাস্তবে তার খুব কমই কাজেকর্মে প্রতিফলিত হতে পারে, মের্কেল যুগের মতোই।
পূর্ব জার্মানির এক প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারে জন্ম নেন মের্কেল। ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও পুরুষতান্ত্রিকতায় পরিচালিত পশ্চিম জার্মান প্রধান নিজ দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টিতেই তিনি ছিলেন তিনগুণ বহিরাগত। লিঙ্গ, ধর্ম ও পূর্ব জার্মান বংশধারা সবই ছিল তাঁর উত্থানের বিপক্ষে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর অধিকাংশ জার্মান রাজনীতিকের মতই তাঁরও ছিল ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ও বাগ্মীতার দৈন্যতা। তাই দীর্ঘ ও শব্দের জাল বুলে আক্রমণাত্মক ভাষণ দেওয়ার চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও প্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিতেই পছন্দ করেন মের্কেল।
রাজনীতিতে নবীন এ নারী জার্মানির সমার্থক হয়ে উঠবেন—এ কথা কেউ কোনোদিন তাঁকে দেখে ধারণাও করতে পারেনি। খোদ তাঁর রাজনীতিক দীক্ষাগুরু ও তৎকালীন চ্যান্সেলর হেলমুট কোহ্লও মের্কেলকে নারী ও পরিবার বিষয়কমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর, জনসম্মুখে তাঁকে 'মেই ম্যাডচেন' বা 'আমার ছোট্ট বালিকা' বলে খাটো করেছিলেন।
কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগ ও ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা জড়িয়ে পড়লে তা মের্কেলের রাজনৈতিক উত্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। ভোটের রাজনীতিতে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক দলের বর্ষীয়ানরা যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন 'ছোট্ট বালিকা'টি যে এসব উচ্চ পর্যায়ের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত নয়, এমন বিশ্বাস পোষণ করেন সিংহভাগ জনতা।
এ সময় লৌহকঠিন দৃঢ়তা ও অসম সাহসিকতার সাথে কোহলকে বর্জন করে মের্কেল জনতার আস্থা অর্জন করেন। এ পদক্ষেপ রাজনীতিক সহকর্মীদের বিস্মিত ও হতবাক করে দিলেও পরবর্তীতে অজস্রবার এ গুণের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। সবাইকে হঠিয়ে উঠে আসেন দলের শীর্ষ পর্যায়ে।
এরপর সামান্য ব্যবধানে নির্বাচনে বিজয়ের পর সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতাকে স্বপক্ষে আনতে পেরেছিলেন মের্কেল। নির্বাচনী বৈতরণী ছাড়া মানুষকে দীর্ঘ ভাষণ ও অহেতুক প্রতিশ্রুতির জোয়ারে ভাসাননি মের্কেল। ফলে ভোটাররাও কখনো তাঁর ওপর তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি।
এসব কিছু তাঁর রাজনৈতিক বিজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। পক্ষান্তরে পূর্ব জার্মানির স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় বড় হওয়া মের্কেল অপার দৃঢ়তা ও সংকল্পের সাথে গণতন্ত্র ও মুক্তির পক্ষে কথা বলতে পারেন। একীভূত জার্মানিতে বহিরাগত হয়েও, প্রকৃত সমবেদনার সাথে বঞ্চিত মানুষের পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন। এমনকি নিজ দলের সংরক্ষণশীলরা ক্ষুদ্ধ হবে জেনেও তিনি শরণার্থী ও অভিবাসীদের আশ্রয়দানের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
কিন্তু একই বৈশিষ্ট্য মের্কেলের কিছু দুর্বলতাকেও ব্যাখ্যা করছে। সংযত বাক্য ও মানবিক বক্তব্যের বিচারে তিনি একজন ঈর্ষনীয় নেতা। কিন্তু কাজের দিক থেকে বিচার করলে, এ রেকর্ড মসৃণ নয়। তাঁর নেতৃত্বে গত দুই দশকে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় জার্মানি।
প্রথমটি এসেছিল ২০০৭-০৯ সালের আর্থিক মন্দার সময়ে। এ সময় দেনার চক্রে পড়ে দক্ষিণ ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র। কোনো দৃঢ়চেতা নেতা হয়তো এ পরিস্থিতিতে বড় অংকের দেউলিয়াত্ব প্যাকেজের আওতায় আর্থিক সহায়তার উদ্যোগ নিতেন বা দেনাগ্রস্ত দেশকে একক মুদ্রাভিত্তিক ইউরো জোনের বাইরে বের করে দিতেন। কিন্তু মের্কেল সে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় তাঁর অধীনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক সঙ্কটের দশক পার করে। যার ফলাফল ছিল—ব্যাপক ধবংসাত্মক।
কিন্তু মানবাধিকারের বিবেচনা ছাড়াও নিজ দেশের আমলাতান্ত্রিক সমস্যা ছিল সীমান্ত বন্ধ না করার অন্যতম কারণ। এ নিয়ে মের্কেলের দৃঢ়চিত্ততার অভাবেই তাঁর দেশে ইসলাম ও শরণার্থীবিদ্বেষ তীব্রতর হয়, যা ডানপন্থী ও নব্য নাৎসিদের উত্থানের সূচনা করে।
শেষমেষ একটি বিশেষ দেশের ইউরো জোনের বাইরে চলে যাওয়ার পরিণতি ঠেকাতে সক্ষম হয় ইইউ। কিন্তু এ সফলতার জন্য চরম আর্থ-সামাজিক মূল্য দিতে হয়েছে, এবং এখনও অনেক কাঠামোগত সমস্যার সমাধান হয়নি। পরবর্তী আর্থিক সংকট দেখা দিলে, একই ট্র্যাজেডি পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি রয়েছে।
দ্বিতীয় বড় ব্যর্থতা ছিল, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে জনসমর্থিত স্বৈরাচারীদের উত্থান ঠেকানোর ক্ষেত্রে। হাঙ্গেরির ভিকটর ওরবান যখন প্রথম নির্বাচিত হন, তখন ইইউ চাইলে যথাযথ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে হাঙ্গেরিকে স্বৈরশাসন থেকে রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু মের্কেল তেমন পদক্ষেপ নেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন এবং ওরবানের দলকে ইউরোপিয় পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে থাকার সুযোগ দেন।
হাঙ্গেরি এখন মুক্তমত ও গণতন্ত্রের দেশ নয়, এবং সমগ্র ইউরোপের ডানপন্থী নেতারা ওরবানের দেখানো মডেল অনুসরণ করছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এসব একনায়করা এখন একে-অপরের দেশের বিরুদ্ধে আসা যেকোনো নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব ভেটোদানের মাধ্যমে বাতিল করছেন। ফলত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বৈরাচারী সদস্য নিয়ে ইইউ একটি গণতান্ত্রিক ক্লাবের মর্যাদা হারিয়েছে।
জার্মানির সামনে তৃতীয় বৃহৎ চ্যালেঞ্জ ছিল সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, যার ফলে ইউরোপমুখী হয় শরণার্থী। এ সময় শরণার্থীদের স্বাগত জানানো প্রথম ইউরোপীয় সরকারপ্রধান ছিলেন মের্কেল, জার্মানির সীমান্ত বন্ধে অস্বীকৃতি বিশ্বজুড়ে তাঁর প্রতি মুগ্ধ অনুরাগীর দল ভারী করে।
কিন্তু মানবাধিকারের বিবেচনা ছাড়াও নিজ দেশের আমলাতান্ত্রিক সমস্যা ছিল সীমান্ত বন্ধ না করার অন্যতম কারণ। এ নিয়ে মের্কেলের দৃঢ়চিত্ততার অভাবেই তাঁর দেশে ইসলাম ও শরণার্থীবিদ্বেষ তীব্রতর হয়, যা ডানপন্থী ও নব্য নাৎসিদের উত্থানের সূচনা করে। এমন একটি দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানি এখন জার্মান রাজনীতির মূলধারায় প্রবেশ করেছে।
অন্যদিকে, আরেক একনায়ক এরদোয়ানের সঙ্গে গোপন ও নিন্দনীয় চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের সীমান্ত শরণার্থীদের জন্য দুর্ভেদ্য করে তোলা হয়। জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত বন্ধ না করলেও, তার ফলে সেদেশে পৌঁছাতেই পারেনি অধিকাংশ শরণার্থী।
প্রশংসিত উদার বিবৃতি ও কাজের মধ্যে এটাই সেই দ্বৈততার পার্থক্য—যা মের্কেল যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও অনুচ্চারিত দিক।
হামবুর্গের সাবেক মেয়র ও নম্রভাষী রাজনীতিক ওলাফ শুলজের মৃতপ্রায় দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নবজীবন পেয়েছে এবারের নির্বাচনের আগে। তাঁর বিপক্ষে লড়বেন মের্কেলের দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের নতুন প্রধান আর্মিন ল্যাসচেট। আরেকটি উল্লেখযোগ্য দল হ্যানোভারের তরুণ আইনপ্রণেতা আন্নালেনা বায়েরবোকের গ্রিন পার্টি।
এসব মূল প্রার্থীর বয়স, জীবনবৃত্তান্ত ও আদর্শিক উৎস ভিন্ন হলেও, সম্মিলিতভাবে তারা সকলেই প্রচলিত উদারনৈতিক রাজনীতির পক্ষের শক্তি। প্রত্যেকটি দলই সামাজিকভাবে উদার এবং কল্যাণরাষ্ট্রে বিশ্বাসী হলেও, বড় ধরনের আর্থিক প্রণোদনার অঙ্গীকার করতে রাজী নয়। দলগুলো ন্যাটো জোটের দৃঢ় সমর্থক এবং সামরিকখাতে ব্যয় বাড়িয়ে জার্মানিকে বৃহৎ সামরিক শক্তিতে পরিণত করার বিপক্ষে।
বলতে গেলে, এসব কিছু মের্কেলের নীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। শুভ সংবাদ এটাই যে, এ নির্বাচনে জার্মানিতে ডানপন্থীদের ক্ষমতা দখলের সুযোগ নেই বললেই চলে।
তারপরও, যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী তারা জার্মানির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হতেই পারেন। কিন্তু, তাই বলে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জার্মান নেতৃত্বের কাছে তাদের খুব বেশি প্রত্যাশারও কোন কারণ নেই।
- লেখক: ইয়াশচা মৌঙ্ক মার্কিন গণমাধ্যম দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিনের একজন নিয়মিত লেখক ও জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বিখ্যাত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশন্স (সিএফআর) এ জ্যেষ্ঠ ফেলো হিসেবে যুক্ত আছেন।
- সূত্র: দি আটলান্টিক থেকে অনূদিত