অ্যাকাডেমিক অসততার ঘেরাটোপে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
একবার মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে নদীর ময়লা পানিতে নামতে দেখে এক পথিক প্রশ্ন করলেন, 'হোজ্জা, নদীতে কী করছেন?' হোজ্জা বললেন, 'গোসল করছি'। পথিক জানতে চাইলেন, 'নদীর এই ময়লা পানিতে গোসল করে কী লাভ?' হোজ্জা হাসিমুখে জানালেন, 'সমস্যা নেই। সাবান দিয়ে গোসল করছি।'
সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকাণ্ড দেখে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের এই গল্পটি মনে পড়ে যায়। কুবিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও এক শিক্ষার্থী মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছে। এত বড় ভুল দেখে প্রশাসন তৎক্ষণাৎ কমিটি গঠন করলো। তদন্ত কমিটি দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলে। প্রশাসন এবার কিছুদিন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে চাইলেও গণমাধ্যমের যন্ত্রণায় তা আর হয়ে ওঠে না। বাধ্য হয়ে তারা 'উচ্চতর তদন্ত কমিটি' নামে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। উচ্চতর এই কমিটি শুধুমাত্র তথ্যদাতাকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। অর্থাৎ প্রশাসন মনে করছে পরীক্ষা না দিয়েও এক শিক্ষার্থীর নাম মেধা তালিকায় আসার ভুলটা আর কারও নয়, শুধুমাত্র তথ্যদাতার। যে শিক্ষক এই তথ্য সরবরাহ করেছেন সমস্ত ভুলের দায় তাঁর। তথ্যদাতাকে শাস্তি দিয়ে সাবান দিয়ে নদীর ময়লা পানিতে গোসল করে পুতপবিত্র হওয়ার মতোই কাজ করেছে প্রশাসন। হোজ্জা এই খবর জানলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্যায় হচ্ছে একাডেমিকা অসততা। সমসাময়িক কিছু ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে অন্যায়টা উচ্চশিক্ষার নতুন কোনো অধ্যায় যা আধুনিক সমাজে মহামারীর মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর মতো সংক্রমিত হচ্ছে। একটি অসততা শেষ হতে না হতে আরেকটি জালিয়াতি আমাদের সামনে হাজির হয়। অ্যাকাডেমিক দুর্নীতি বা অসততা বলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ন্যায়বিচার, সততা, ন্যায্যতা, সম্ভাবনা, নিরপেক্ষতা এবং শৃঙ্খলা থেকে বিচ্যুতিকে বোঝানো হয়। মূলত নৈতিক কলুষতা থেকে অ্যাকাডেমিক দুর্নীতির সৃষ্টি হয় এবং এর সাথে জড়িত স্বার্থপর মনোভাব শিক্ষার লক্ষ্য এবং সমাজের অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর।
তবে এই দুর্নীতি আমাদের দেশ থেকেই শুরু নয়, এর ইতিহাস অনেক পুরনো। চেস (২০১২) কয়েক দশক ধরে তাঁর প্রতিটি গবেষণায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আমেরিকান কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর পরিমাণে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে।
এ বাদেও অসততার প্রাচীনতম উদাহরণগুলোর একটি হচ্ছে চীনের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা। ১৪০০ বছর পূর্বে সংঘটিত কাজু (চীনা শব্দ) পরীক্ষায় দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। আমেরিকান উচ্চশিক্ষার ইতিহাসের এক চমকপ্রদ উদাহরণ এসেছে ইয়েলের কাছ থেকে। ১৮৬০ এর দশকে ইয়েলে ছাত্র সংগঠনের অর্ধেক বিভিন্ন কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে অ্যাকাডেমিক অসততার ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। মৌলিক গবেষণার ঘাটতি থাকলেও প্রশাসনিক মৌলিক দুর্নীতির তেমন কোনো ঘাটতি সাম্প্রতিক সময়ে চোখে পড়ে না।
শুধু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই বেশ কিছুদিন ধরে অনিয়মের ফুলঝুড়ি চলছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান তাঁর মেয়াদের শেষ কার্যদিবসে বিভিন্ন পদে ১৪১ জনকে একযোগে নিয়োগ দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। এই নিয়োগে বিপুল অর্থের লেনদেন এবং সরকার দলীয় লোকজনকে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর আগে উপাচার্য তাঁর মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনও পরিবর্তন করেছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাত ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে ৩০টির বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ ১১১টি দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শহীদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে পরিবারের সদস্যদের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়াসহ অন্তত ১৫টি অভিযোগ আছে। এছাড়া দেশের আরও বেশ কিছু সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা বা পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া, অভ্যন্তরীণ আয় বাজেটে না দেখানোসহ অন্তত ২৪ ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যেকোনো ধরনের অনিয়মে ইউজিসি (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করলেও থেমে নেই দুর্নীতির চাকা।
ওয়ার্ল্ড এডুকেশন নিউজ রিভিউয়ের সম্পাদক স্টিফেন ট্রাইনসের মতে, যে সব দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে দুর্বল ভূমিকা পালন করে, সেখানকার প্রতিটি খাতে দুর্নীতি জেঁকে বসে। তাই বলে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে ভাবলে ভুল হবে। জার্মানিতে শতকরা তিন শতাংশ পিএইচডির ক্ষেত্রে ঘোস্টরাইটার বা পরিচয় গোপন রেখে লেখক ভাড়া করা হয়। আর আমাদের দেশে তো সোজা কাট-কপি-পেস্ট সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। অ্যাকাডেমিক এই জালিয়াতি বা অসততার পেছনের কারণগুলো একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
ভারতীয় গবেষক মীত এবং নারায়ণ এক গবেষণায় দেখেছেন, সরকারের কর্তৃত্বাধীন যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তারা ক্ষমতার একচেটিয়া অপব্যবহার করেন, সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে, ব্যবসায়িক বিধিবিধান ও পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নিয়ম রয়েছে, সেখানে দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ বেশি। তাছাড়া মাথাপিছু উচ্চ জিডিপি, উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মুক্ত গণমাধ্যমের নিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকার চাপ দুর্নীতির সাথে নেতিবাচকভাবে জড়িত। এত শত ইস্যু মাথায় রেখে কোনো দেশে অ্যাকাডেমিক অসততা সমাধানের কোনো সাধারণীকৃত সূত্র খুঁজে বের করা দুষ্কর। তার উপর দুর্নীতি বা অসততা এমনই এক বিষয় যা মেপে দেখার কোনো উপায় নেই। তুলনামূলক কম গণতান্ত্রিক দেশ রুয়ান্ডায় উচ্চশিক্ষায় দুর্নীতির হার ভারতের মতো বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় অনেক কম। এই সমীকরণ মেলানোর একের ভেতর সব জাতীয় সূত্র নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও প্রশাসনকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা জরুরী। প্রতিটি নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ও বাজেটে আয়-ব্যয়ের হিসেব মেলাতে ইউজিসিকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে যেসব উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে সতর্ক করে দেওয়া যেতে পারে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন যেন জনসম্মুখে প্রকাশিত হয় সেদিকেও ইউজিসিকে সোচ্চার হতে হবে। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বচ্ছ রাখতে হবে। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে প্রশাসনকেও তখন দুর্নীতি বাদ দিয়ে কিছু কাজের কাজ করতে হবে। তা না হলে শিক্ষক-প্রশাসন দ্বন্দ্ব বা দুর্নীতির কারণে শিক্ষার গুণগত মানের অবনতি ঘটবে। আর এর গুরুতর প্রভাব পড়বে চিকিৎসা, নার্সিং, প্রকৌশল, শিক্ষা, আইনসহ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি খাতে।
লেখক:
- ফারজানা তাসনিম, প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
- মেহেদী হাসান রাজীব, প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস