হইচই ফেলে দেওয়া ‘জয় ভীম’ সিনেমার আসল নায়ক এই বিচারপতি!
হইচই ফেলে দেওয়া তামিল সিনেমা 'জয় ভীম'-এ সুরিয়া শিবকুমারকে দেখা যায় এক আদিবাসী নারীর অধিকার আদায়ের জন্য আইনি লড়াইয়ে নামতে। ছবিতে তাকে নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে আইনি লড়াইয়ে জিততে দেখা যায়।
এসব রোমাঞ্চকর ঘটনা কিন্তু স্রেফ রুপালি পর্দার জন্য লেখা নয়, ঘটনাগুলো এসেছে বাস্তবজীবন থেকে। আর বাস্তবের সেই নায়কের নাম বিচারপতি কে. চান্দ্রু।
ছবিটি তৈরি হয়েছে ১৯৯৩ সালে তামিলনাড়ুর কাড্ডালোর জেলায় ঘটে যাওয়া এক সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। বাস্তবের ঘটনায় রাজাকান্নু ছিলেন আন্দাই কুরুম্বার গোত্রের সদস্য, পেশায় বাঁশের ঝুড়ি নির্মাতা ও কৃষি শ্রমিক। যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেখান থেকে গয়না চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি।
পুলিশ হেফাজতে অত্যাচারে রাজকান্নু মারা যান। এই অপরাধ ধামাচাপার দেওয়ার জন্য স্থানীয় পুলিশ রাতের আঁধারে রাজকান্নুর মরদেহ সরিয়ে ফেলে। লাশ ফেলে দেয় পার্শ্ববর্তী তিরুচিরাপল্লি জেলায়। পরে দাবি করে যে, রাজকান্নু তাদের হেফাজত থেকে পালিয়ে গেছে।
কিন্তু পুলিশের গল্প বিশ্বাস করেননি রাজকান্নুর স্ত্রী পার্বতী। স্বামীকে খুঁজে বের করতে সাহায্যের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। অবশেষে মাদ্রাজ হাইকোর্টে পেয়ে যান এক উকিলের সন্ধান—কে. চান্দ্রু। পার্বতীর ন্যায়বিচার পাওয়ার যাত্রায় পথে নামেন তিনিও।
কে. চান্দ্রু—পরবর্তীতে মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় বিচারক—মাদ্রাজ হাইকোর্টেই হিবিয়াস কর্পাস পিটিশন করেন। দীর্ঘ ১৩ বছরের আইনি যুদ্ধের পর আদালত রায় দেন যে, এটি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর মামলা। রাজকান্নুকে নির্মমভাবে হত্যার জন্য অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মামলা চলাকালে পুলিশ পার্বতী ও চান্দ্রুকে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। চান্দ্রু টাকাভর্তি সুটকেস ছুড়ে ফেলেছেন।
শুধু পার্বতী নয়, এরকম আরও সহস্র প্রান্তিক ও নিপীড়িত অসহায় মানুষকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছেন বিচারপতি কে. চান্দ্রু।
মাদ্রাজ হাইকোর্টে সাড়ে ছয় বছর বিচারক ছিলেন কে. চান্দ্রু। এই সময়ে তিনি ৯৬ হাজার মামলার নিষ্পত্তি করেন। অর্থাৎ, দিনে গড়ে ৭৫টি মামলার শুনানি করেছেন। সুচারু পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে এই অসাধারণ কাজ করেছেন তিনি।
এছাড়াও কে. চান্দ্রু বেশ কিছু মাইলফলক রায় দিয়েছেন। রায়গুলো সামাজিক ন্যায়বিচারকে কেন্দ্র করে দেওয়া। নারীরা কেন মন্দিরের পুরোহিত হতে পারবেন না, জাত-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য একটি সাধারণ সমাধিস্থল থাকা উচিত এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা সরকারি কর্মচারীর চাকরির সুরক্ষা প্রদান—এসব তার দেওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রায়।
কে. চান্দ্রু সারা জীবন কাটিয়েছেন নিপীড়িত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য লড়াই করে। কাটিয়েছেন অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন। কখনও টাকার জন্য কাজ করেননি। 'পাঁচ তারকা উকিল' হওয়া তার জীবনের লক্ষ্য ছিল না।
বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় উকিলদের নিষেধ করতেন আদালতে তাকে যেন 'মাই লর্ড' বলে সম্বোধন না করেন। আদালতে নিজের আগমনবার্তা বেয়ারা দিয়ে ঘোষণা করানো পছন্দ করতেন না। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা (পিএসও) রাখতেও রাজি হননি তিনি। এমনকি বিচারপতিদের মহা-আরাধ্য 'ফেয়ারওয়েল'-এও সটান 'না' বলে দিয়ে অবসর নেওয়ার দিন সন্ধ্যায় আদালতের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাসে চেপে বাড়ি ফিরেছিলেন।
কে. চান্দ্রুর জন্ম রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে। ছাত্রজীবনে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অভ ইন্ডিয়ার (মার্ক্সিস্ট) নেতা। ছাত্র ও কর্মচারীদের অধিকার আদায়ে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া ছিল চান্দ্রুর ছাত্রজীবনের নিয়মিত ঘটনা। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তেন। ছাত্রবিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাকে চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
অধিকারকর্মী ও ট্রেড ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনে যেতে চান্দ্রু। সেখানকার শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। লরিতে-বাসে চড়ে গোটা তামিলনাড়ু চষে বেড়িয়েছেন। দলিত শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রান্তিক এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা সম্পর্কে অমূল্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
এক বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিচার্জে আন্না ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র মারা যাওয়ার পর তার মৃত্যুর তদন্তে গঠিত কমিশনের কার্যক্রম দেখে আইন পেশায় ঢোকার ইচ্ছা প্রবল হয় চান্দ্রুর। ওই কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন মাদ্রাজ হাইকোর্টের একজন অতিরিক্ত বিচারক, ছাত্রদের পক্ষ থেকে তার সামনে হাজিরা দিয়েছিলেন চান্দ্রু।
চান্দ্রু কতটা প্রস্তুতি নিয়ে কমিশনের সামনে হাজির হয়েছিলেন, তা দেখে ওই বিচারক তাকে আইন পেশায় আসার পরামর্শ দেন। ১৯৭৩ সালে চান্দ্রু ল' কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ছাত্রকর্মী হিসেবে তার অতীত-ইতিহাসের জন্য তাকে হোস্টেলে সিট দেওয়া হলো না। এর জেরে টানা তিন দিন অনশন করেন চান্দ্রু। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে হোস্টেলে সিট দেয় কর্তৃপক্ষ।
আইনে স্নাতক করার পর চান্দ্রু আট বছর একটি আইন সংস্থায় কাজ করেন। এরপর নিজের সংস্থা চালু করেন। সর্বকনিষ্ঠ উকিল হিসেবে তামিলনাড়ু বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
২০০৬ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত হন চান্দ্রু। দায়িত্ব পালনকালে তিনি বেশ কিছু যুগান্তকারী রায় দেন।
মাদ্রাজ হাইকোর্ট থেকে অবসর নেওয়ার পর বিচারপতি চান্দ্রু সুশীল সমাজের সক্রিয় প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। আইন নিয়ে অজস্র কলাম লিখেছেন পত্রপত্রিকায়, লিখেছেন বইও। তার সর্বশেষ বই 'লিসেন টু মাই কেস: হোয়েন উইমেন অ্যাপ্রোচ দ্য কোর্টস অভ তামিলনাড়ু' এ বছরের শুরুর দিকে প্রকাশিত হয়। বইটিতে তিনি ন্যায়বিচারের জন্য ২০ নারীর লড়াইয়ের কাহিনি তুলে ধরেছেন।
অসাধারণ এক জীবন কাটিয়েছেন কে. চান্দ্রু। সেই জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উঠে এসেছে 'জয় ভীম' ছবিতে।