সত্যজিৎ বললেন, ‘ইউরেকা! ইউরেকা! আমি পেয়েছি অনঙ্গ বউকে’
আজ কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী। তিনি ছিলেন একধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক ও লেখক। তাকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়।
কিংবদন্তি এই ভারতীয় চলচ্চিত্রকারের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের বরেণ্য অভিনেত্রী ববিতা। বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি জাতীয় পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তার জীবনের অন্যতম অর্জন সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় করা, এমনটাই দাবি স্বয়ং ববিতার।
'অশনি সংকেত' নামের ওই ছবি মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন কলকাতার আরেক বরেণ্য অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সত্যজিতের জন্মদিন উপলক্ষে ববিতার সঙ্গে কথা হয় গত ১ মে। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে বলেছেন সত্যজিতের সঙ্গে পরিচয় ও 'অশনি সংকেত' সিনেমায় যুক্ত হওয়ার গল্প।
ববিতা বলেন, 'তখন সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি মাত্র কয়েকটা সিনেমা করেছি। ঘটনাটা ১৯৭২ সালের শেষ দিকে বা ১৯৭৩ সালের শুরুতে হবে। এফডিসিতে শুটিং করছিলাম। খেয়াল করলাম কেউ একজন আমার ছবি তুলছেন। একজন বলল, ইন্ডিয়া থেকে এসেছে। সবকিছু দেখে ছবি তুলছে। খুব বেশি গুরুত্ব দিলাম না।'
'তখন আমরা পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াতে থাকি। ওই ছবি তোলার ঘটনার কয়েকদিন পর আমাদের বাসার ঠিকানায় আমার নামে একটি চিঠি এলো। চিঠি পড়ে আমরা অবাক। সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে ছবির ব্যাপারে দেখা করতে যেতে হবে ভারতে। শুরুতে অবাক হলেও পরে ব্যপারটা নিয়ে হাসাহাসি করি আমার বোনেরা মিলে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, এটা কেউ মজা করে লিখেছে। আমাদের কোনো বন্ধু বা ভক্ত। তাই পরের দিনই চিঠির কথা ভুলে গেলাম,' বলেন তিনি।
"কিন্তু কয়েকদিন পর ঘটল আরেক ঘটনা। বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাস থেকে বাসায় ফোন করা হলো বাসার টিঅ্যান্ডটি ফোনে। আমাকে আবারও বলা হলো, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে। ওপাশ থেকে বলল, 'কয়েকদিন আগে চিঠি পাঠানো হয়েছিল, আপনারা বোধহয় গুরুত্ব দেননি।' এসব শুনে একটু বোকা বনে গেলাম। ওই চিঠি কি সত্যি ছিল?"
ববিতা বলেন, 'তখন আমার বয়স ১৫ বা ১৬ বছর। পরে কয়েকদিনের মধ্যে সুচন্দা আপাকে নিয়ে কলকাতায় যাই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে।'
স্মৃতিচারণায় তিনি আরও বলেন, "তখন ওই ছবির প্রডিউসার নন্দা ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা হলো। তিনি আমাদের কলকাতা যাওয়ার ব্যাপার সহযোগিতা করলেন। ওটাই আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। আমাদের দেখা হওয়ার ঘটনা খুব অদ্ভুত। আমরা গিয়ে গ্রান্ড ওয়েরর হোটেলে উঠলাম। পরদিন তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি সকালে উঠে ভাবলাম, এত বড় মাপের একজন পরিচালক আমাকে দেখবেন, একটা প্রস্তুতি তো আছে। আমি খুব কড়া মেকআপ করলাম। সেজেগুজে হাজির হলাম তার বাড়িতে। দরজা খুললেন স্বয়ং সত্যজিত। আমি তো অবাক। এত লম্বা মানুষ! আমি ঘাড় উঁচু করে তাকালাম। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, 'তুমি এত মেকআপ করে এসেছ কেন? আমি তো তোমাকে মেকআপ অবস্থায় দেখতে চাইনি।' এটা শুনে আমার খুব মন খারাপ হলো। ভয়ও পেয়ে গেলাম। তার ছবিতে অভিনয়ের আশা ছেড়ে দিতে হবে। পুরোটা সময় মাথা নিচু করে থাকলাম।"
"এরমধ্যে বিজয়া বৌদি (সত্যজিতের স্ত্রী) চা নাস্তা দিয়ে গেলেন। কিন্তু আমি কোনোভাবেই সত্যজিৎ বাবুর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কথাও বলতে পারলাম না আর। তখন সুচন্দা আপাকে তিনি বললেন, 'তোমার বোন কি অনেক লাজুক? ও কি অভিনয় করতে পারবে?'"
"তখন আপা বললেন, 'দাদা, বাংলাদেশে ওর দু-তিনটা ছবি রিলিজ হয়েছে। ওকে বাংলাদেশের দর্শক খুব পছন্দ করেছে।' উনি 'তাই নাকি' বলে আমাকে তিনটা ছোট চিত্রনাট্য দিলেন। তারপর বললেন, 'তুমি কাল এগুলো মুখস্ত করে ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে আসবে। সেখানে তোমার অডিশন, স্ক্রিন টেস্ট আর ভয়েসটা চেক করব।"
"আমি পরদিন কোনো মেকআপ না করেই হাজির হলাম ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। তিনি খুব খুশি হলেন। বললেন, 'আজ তোমাকে তো বেশ সুন্দর লাগছে।' আর মেকআপম্যানকে বলে দিলেন, 'ওকে কোনো মেকআপ দিবে না। সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে দাও, আর কপালে টিপ থাকবে আর আটপৌরে শাড়ি পরবে।'"
ববিতা আরও বলেন, "তারপর সবকিছু করে মেকআপ রুম থেকে স্টুডিওতে ঢুকলাম। দেখলাম, সত্যজিৎ বাবু ক্যামেরাতে লুক থ্রু করছেন। আমাকে ক্যামেরায় দেখলেন কয়েকবার। তারপর আমাকে বললেন, 'তোমাকে যে স্ক্রিপ্ট দিয়েছিলাম, সেগুলো তোমার মতো করে অভিনয় করে যাও।' এগুলো কোনোটা রোমান্টিক, কোনোটা সিরিয়াস, কোনোটা একুট আলাদা। আমি আমার মতো করে বললাম। উনি কী বুঝলেন, আমি জানি না। সম্ভবত আমার মধ্যে যে চেষ্টা বা অভিনয় করার ধরন, সেটা ওনার চোখে পড়েছে। ভালো লেগেছে বোধহয়। শেষ হওয়ার পরপরই ক্যামেরার আসন থেকে নেমে এসে বললেন, 'ইউরেকা! ইউরেকা! আমি পেয়ে গেছি আমার অনঙ্গ বউকে।'"
এসব ঘটনার পর ববিতাকে পুরো সিনেমার স্ক্রিপ্ট দেওয়া হয়। কিছুদিন পর থেকে শুরু করেন 'অশনি সংকেত' সিনেমায় অভিনয়। শুটিং করেছেন শান্তি নিকেতনে। তার বিপরীতে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সৌমিত্র প্রসঙ্গে ববিতা বলেন, "ওনাকে দেখলাম গঙ্গাচরণ চরিত্রের পোশাক পরা, ধুতি পরা। গোল গোল চশমা। আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওনার সঙ্গে আমি শট দিলাম। তার পর উনি বললেন, 'বাহ তুমি তো খুব সুন্দর শট দিয়েছ! খুব সুন্দর!'"
সৌমিত্রের সেই প্রশংসা তাকে তখন সাহস জুগিয়েছিল বলে অকপট স্বীকারোক্তি ববিতার।
'অশনি সংকেত' ছবিটি মুক্তির আগেই জার্মানির বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পৌঁছে যায়। সেখানে সিনেমাটিকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার 'গোল্ডেন বিয়ার' দেওয়া হয়। 'অশনি সংকেত'-এর নায়িকা হিসেবে ববিতা ভারতে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিজম অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কার পান।
তবে এসবের চেয়ে বড় পাওয়া, সত্যজিতের সঙ্গে পরিচয় এবং তার পরিচালিত সিনেমায় অভিনয় করাটা- এমনটাই মনে করেন ববিতা।