মিনা পাল থেকে কবরী
১৯৫২ সালের জুলাই মাসে জন্মগ্রহন করেন মিষ্টি মেয়ে কবরী। তাব বাবা কৃষ্ণদাস পাল। মা শ্রীমতী লাবণ্য প্রভা পাল। অবশ্য তার মা তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। বাবার আগের স্ত্রীর ছিল দুই মেয়ে, দুই ছেলে। দ্বিতীয় স্ত্রীর পাঁচ ছেলে, চার মেয়ে। এই চার মেয়ের দ্বিতীয় মিনা পাল (কবরী)। তবে মা আলাদা হলেও সব ভাইবোন একসঙ্গে বড় হয়েছেন। ভাইবোনরা মিলে নাচ-গান করতেন। মিনা পালও ছিলেন সেই দলে। পরিবারের সবার প্রিয় ছিলেন মিনা পাল।
পুরো পরিবার থাকত চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারে। মিনা পাল পড়তেন আল করন স্কুলে। সেখানে পড়েন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর মা কবরীদের জে এম সেন হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। তো সেই স্কুলে আয়োজিত সাংস্কৃতিক আয়োজনে মঞ্চস্থ করা হয় ক্ষুধা নাটকটি। সেখানে একজন ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন মিনা পাল। ওখানেই মিনা পালের অভিনয়ের হাতেখড়ি।
ছোটবেলায় মিনাদের ঘরে কোনো টেলিভিশন ছিল না, একটা রেডিও ছিল। রেডিওর গান শুনে বোনরা কেউ নাচতেন আবার কেউ তাল মিলিয়ে গান গাইতেন। একসময় রুনু বিশ্বাসের কাছে নাচ শেখা শুরু করলেন মিনা। তার বাবা আবার এসবে খুব উৎসাহ দিতেন। এরপর থেকেই বোনদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে লাগলেন, নাচতেন। পাশাপাশি পড়াশোনা যেন ঠিক থাকে, সেদিকটায় আবার তাড়া দিতেন মা। এভাবেই ভাইবোনেরা বেড়ে উঠেছেন।
তখন কিশোর বয়সে পা দিয়েছেন মিনা। ১৩-১৪ বছর বয়স। সময়ের সঙ্গে আর সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠছেন। কখনো চলচ্চিত্রে পা রাখবেন সেই চিন্তাও মাথায় ছিল না তার।
এদিকে ঢাকার চলচ্চিত্রে নতুন একটি ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন অভিনেতা সুভাষ দত্ত। ছবির নাম 'সুতরাং'। আর চরিত্রের নাম জরিনা। তবে মেয়েটি এমন, যিনি নায়িকা হবেন স্বয়ং সুভাষ দত্তেরই বিপরীতে। ওই সময় ছবির সংগীত পরিচালক সত্য সাহা মিনা পালের সন্ধান দিলেন সুভাষ দত্তকে। বিস্তারিত জানার পর সুভাষ দত্ত সত্য সাহাকে নিয়ে বিমানে চট্টগ্রামে গেলেন। চট্টগ্রামের ডা. কামালের সঙ্গে মিনা পালের বাবার পরিচয় ছিল। ডা. কামালকে নিয়েই কবরীদের বাড়িতে গেলেন সুভাষ দত্ত।
দুঃখের ব্যাপার হলো সেদিন বাড়ি ছিলেন না মিনা পাল। ওই সময় তিনি ছিলেন ময়মনসিংহে। ফিরে আসনে সুভাষ দত্ত ও সত্য সাহা। চট্টগ্রামে আসার পর মিনা পালের বাবা সত্য সাহাকে খবর দেন, সে ফিরেছে। কিন্তু এবার আর সুভাষ দত্ত চট্টগ্রাম গেলেন না। কিছু ছবি তুলে পাঠাতে বললেন। ডা. কামালকে পাঠালেন মিনা পালের কিছু ছবি তোলার জন্য। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই সুভাষ দত্তের। মিনা পাল ধরে নিয়েছিলেন হয়তো পছন্দ হয়নি। তবে সুভাষ দত্তের বেলায় ঘটেছে উল্টো ঘটনা। মিনা পালের ছবিগুলো দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে হাসি। খবর পাঠানো হলো, তাকে যেন ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
কিন্তু মিনা পালের মা মেয়েকে ঢাকায় পাঠাবেন না। মা-ভাই–বোনদের ছেড়ে ঢাকায় আসতে ভালো লাগছিল না তারও। রক্ষা করলেন বাবা। বললেন, আগে মিনা যাক। যদি ভালো না লাগে, তাহলে চলে আসবে, এই বলে বাবা তাকে নিয়ে রওনা দিলেন। উঠলেন ট্রেনে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা। ঢাকায় এসে উঠলেন পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে। সেদিন সুভাষ দত্ত দাদার সামনে এসে দাঁড়ালেন কমলা রঙের একটা ফ্রক পরে। তারপর শাড়ী পড়ে এলেন। সুভাষ দত্তের পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু ভয়েস টেস্ট করতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি। কথার মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিকতার টান। সুভাষ দত্তের নায়িকাকে বলতে হবে শুদ্ধ বাংলা। উপায়।
এক সাক্ষাৎকারে ওই সময়ের স্মৃতিচারণে কবরী বলেছিলেন, 'দাদা আমাকে যেভাবে সংলাপ বলতে বললেন, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে সেভাবেই সংলাপ আওড়াতে থাকলাম। অবশেষে দাদা জানালেন, জরিনা চরিত্রের জন্য আমাকে তার পছন্দ হয়েছে। তারপর শুরু হলো আমার নাম নিয়ে গবেষণা। দাদা সৈয়দ শামসুল হককে আমার একটা নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য বললেন। যে নামেরই প্রস্তাব আসে, দেখা যায় এই নামে কেউ না কেউ আছে। আবার কোনো কোনো নাম দাদার পছন্দ হয় না। একবার ঠিক হলো যে "করবী" দেওয়া হবে। কেউ আবার বলল না, "কবরী"।
দুটো নাম নিয়ে বেশ ভাবনাচিন্তা চলল। শেষতক "কবরী" নামটাই টিকে গেল। আর "মিনা পাল" থেকে আমি হয়ে হলাম "কবরী"।'
মিনা পাল থেকে কবরী হয়ে অভিনয় করলেন সুতরাং ছবিতে। সুভাষ দত্তের মতো শক্তিমান অভিনেতার বিপরীতে। ছবি হিট হয়ে গেল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন পড়েনি। 'ময়নামতি', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'সারেং বৌ', 'নীল আকাশের নীচে', 'সুজন সখী'র মতো ছবিগুলোয় দর্শকেরা অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন বাংলাদেশের চিত্রজগতের অসামান্য এক তারকার তারকা হয়ে ওঠা। অভিনয়ে, প্রযোজনায়, পরিচালনায়—তার সাত দশকের জীবনটা যেন আশ্চর্য সফলতার গল্প। সবশেষ তিনি পরিচালনা করেছেন সরকারি অনুদানের ছবি এই তুমি সেই তুমি। ছোট্ট একটা চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছেন। ছবিটির শুটিং শেষ হয়ে গিয়েছিল। ডাবিং ও সম্পাদনা চলছিল। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আরও একটি ছবি নির্মাণের। তবে সবকিছু রেখে চিরবিদায় নিলেন কবরী।