বাসুদার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অদ্ভুত ছিল: ফেরদৌস
গত বৃহস্পতিবার মারা গেছেন ভারতীয় সিনেমার প্রখ্যাত নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার বাসু চ্যাটার্জী। বার্ধক্যজনিত কারণেই মৃত্যু হয়েছে তার। অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র থেকে শুরু করে ভারতীয় অভিনেতা প্রসেনজিত তার পরিচালনায় কাজ করেছেন।
তবে বাংলাদেশের দর্শকের কাছে তিনি পরিচিত 'হঠাৎ বৃষ্টি' নামের চলচ্চিত্রটির জন্য। দুই দশক আগে যে ছবিতে বাংলাদেশ থেকে অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস! এই সিনেমায় অভিনয়ের পরপরই মূলত আলোচনায় আসেন এই অভিনেতা। তার আগে অবশ্য মাত্র দেশের একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল তার। সালমান শাহর মৃত্যুর পর 'বুকের ভিতর আগুন' সিনেমার মাধ্যমে অভিষেক হয় ফেরদৌসের। তারপরই বাসু চ্যাটার্জির হাত ধরেই অভিনয় করেন 'হঠাৎ বৃষ্টি' তে।
এই সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে একটা চমৎকার সম্পর্ক হয়ে যায় পরিচালক ও অভিনেতার। ফেরদৌসের ভাষায়, 'ডিরেক্টর-হিরোর সম্পর্ক ছাপিয়ে আমাদের সম্পর্ক রূপ নিয়েছিল পিতা-পুত্র, বন্ধু কিংবা গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে!'
গত শুক্রবার রাতে দ্য বিজসেন স্ট্যান্ডার্ডের কাছে ফেরদৌস বলেন বাসু চ্যাটার্জীকে নিয়ে। তিনি বলেন, "খবরটা আমার জন্য খুবই মন খারাপের। তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর সবকিছু ওলটপালট লাগছে। কারন তার সঙ্গে এমনকি তার পরিবারের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কদিন আগেও তার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। জানিয়েছিলেন তার বাবা মানে বাসুদা অসুস্থ। শরীর ঠিক নেই, চলাফেরা করতে পারছেন না। সার্বক্ষণিক খবর রাখছিলাম ওনার শারীরিক অবস্থার।"
বাসু চ্যাটার্জীর সঙ্গে পরিচয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "তার সঙ্গে আমার দেখা হয় ঢাকার গুলশান ক্লাবে। এটা ১৯৯৭ সালের কথা। তার আগের বছর আমার 'বুকের ভিতর আগুন' সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। তারপর কলকাতার একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার। তিনি শ্রীলেখা মিত্র। তো ওই দিন বাসুদার সঙ্গে দেখা হওয়াটা কাকতালীয়। কি একটা কাজে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার কাছের দুজন পরিচালক বলেন ওনার সঙ্গে দেখা করতে। তারপর সেখানে গিয়ে দেখা হয়ে যায়। ওই দিনই তিনি আমাকে 'হঠাৎ বৃষ্টি'র স্ক্রিপ্ট দিয়ে দেন। তারপর কলকাতা নিয়ে যান। কলকাতা যাওয়ার পর তিনি আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে 'হঠাৎ বৃষ্টি'র কস্টিউম কিনে দেন। ওই সময় থেকেই আমাদের মধ্যে যে অদ্ভুত রিলেশন তৈরি হয়।'
হঠাৎ বৃষ্টি সিনেমার করার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে ফেরদৌস বলেন, 'প্রথম যখন শুটিং শুরু করি তখন একটা ভয় ছিল। কিন্তু বাসুদা এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি অভিনেতার ভেতর থেকে অভিনয় বের করে নিতে পারতেন। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। তিনি প্রচুর রিহাসেল করাতেন। শর্ট নিতেন কম। তাই শর্টে এনজি হতো না। সত্যি কথা হলো উনি একজন কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। সময় মেনে চলতেন। ওনার ভেতর ভালো কাজ করার একটা মানসিকতা সব সময় ছিল। কলকাতার সিনেমায় আমার যতটুকু অবদান তার পেছনে বাসুদার একটা বড় ভূমিকা আছে। ওনার মতো এত আন্তরিক মানুষ আমি দেখিনি।'
বলিউডের 'মিট্টি' নামে সিনেমায় অভিনয় করার সময় বাসুদা অনুরোধ করেছিলেন তার বাসায় থাকতে। তবে থাকা হয়নি। নিয়মিত আ্ড্ডা মারতে যেতেন ফেরদৌস। সেই স্মৃতি মনে করে ফেরদৌস বলেন, তার পরিবারের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। এমনকি তার মেয়ে রূপালী গুহ পরিচালিত 'পরিচয়' সিনেমাতেও আমি অভিনয় করেছি। বলতে পারেন ১৯৯৭ সাল থেকে এখন অবধি বাসুদা এবং তারা পরিবারের সঙ্গে আমার একটা দারুন সম্পর্ক বয়ে নিয়ে চলেছি।'
ফেরদৌস জানান, এখন অবধি বাসু চ্যাটার্জী পরিচালিত চারটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। হঠাৎ বৃষ্টি ছাড়া বাকি সিনেমাগুলো হলো- 'চুপিচুপি', 'টক ঝাল মিষ্টি', 'হঠাৎ সেদিন'। বাসু চ্যাটার্জির লেখা সিনেমার চিত্রনাট্য 'এক কাপ চা' দিয়ে প্রযোজক হিসেবে নাম লেখান ফেরদৌস।
বাসু চ্যাটার্জির 'বিয়ের ফাঁদে' নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রয়েছে ফেরদৌসের কাছে। খুব তাড়াতাড়ি সেটির নির্মান কাজ শুরু করবেন বলে জানান তিনি।
কথা শেষ করার আগে আগে ফেরদৌস বলেন, "আসলে বাসুদার সাথে আমার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক অন্য কাউকে বোঝানোটা কঠিন। যেটা ফিল্মের মানুষের মধ্যে খুব কম গড়ে উঠতে দেখেছি আমি।"
"অনেকদিন ধরেই তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। দু-একটা শব্দ বলতে পারছিলেন কেবল। আসলে স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছিলো দিনকে দিন এবং কথা বলতেও প্রবলেম হচ্ছিল। চোখের সামনে আমি দেখলাম এমন একজন প্রাণশক্তি সম্পন্ন মানুষ কীভাবে নিঃশ্বেষ হয়ে গেল! প্রাকৃতিকভাবেই তিনি চলে গেলেন, প্রচুর স্মৃতি তিনি রেখে গেলেন আমাদের জন্য। এমন একটা সময়ে তিনি চলে গেলেন যে তাকে শ্রদ্ধা জানাব সেটাও সম্ভব হলো না, সবকিছুই এখন ভার্চুয়ালি করতে হচ্ছে।"