পরীমনি বিষয়ে আমাদের এত জাজমেন্টাল হওয়া ঠিক নয়: সেলিম
জনপ্রিয় পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম শুরু করেছেন তার চতুর্থ ছবি 'গুনিন'-এর শুটিং। পরীমনি ও শরীফুল রাজকে নিয়ে শুরু হওয়া ছবিটি প্রযোজনা করছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি।
শুটিংয়ে যাওয়ার আগে গিয়াস উদ্দিন সেলিম কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে।
শুনিয়েছেন তার সিনেমা ও ব্যক্তিগত বিষয়ে বিস্তারিত।
টিবিএস: শুরুতে আপনার চতুর্থ চলচ্চিত্র 'গুনিন' সম্পর্কে একটু জানতে চাই।
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: 'গুনিন' নিয়ে বলার আগে প্রিয় লেখক হাসান আজিজুল হকের কথা বলতে চাই। তিনি একটা অসাধারণ গল্প লিখেছেন, যেটা পড়ে আমার মনে হয়েছে এটা নিয়ে একটা সিনেমা বানানো যেতে পারে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাই তার একটা গল্প নিয়ে সিনেমা বানানো আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ কারণেই প্রবল আগ্রহ নিয়ে কাজটা করছি। গল্পটা বলতে চাই না। দর্শক একেবারে পর্দায় গল্পটা দেখুক। এটা চরকির একটা ফিচার ফিল্ম। মানে, আগে এটা সিনেমা হলে রিলিজ হবে; তারপর চরকিতে দেখা যাবে।
টিবিএস: শুটিং কোথায় করছেন এবং অভিনশিল্পী আর কে কে?
সেলিম: সঙ্গত কারণেই কোথায় শুটিং করছি, এটা এখনই জানাতে চাই না। তবে ঢাকার বাইরে শুটিং করছি। পরীমনি ও শরিফুল রাজের পাশাপাশি আরও অভিনয় করবেন মোস্তফা মনোয়ার, শিল্পী সরকার অপু, দিলারা জামান, আজাদ আবুল কালামসহ অনেকেই ।
টিবিএস: আপনার চার নম্বর সিনেমার শুটিং চলছে। চারটা সিনেমার মধ্যে দুটির নায়িকা পরীমনি। বিশেষ কোনো কারণ আছে?
সেলিম: এটা আসলে পরিস্থিতির কারণে। ফিল্মমেকিং এমন একটা জিনিস, কার রিজিক কোথায়, আমরা কেউ জানি না। প্রজেক্টের প্রয়োজনেই হয়তো এসেছে। অন্য কোনো কারণ নেই।
টিবিএস: সম্প্রতি আইনি ঝামেলাসহ পরীমনির জীবনে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। নতুন ছবিতে তাকে নেওয়া আপনার কাছে ঝুঁকি বলে মনে হয়নি?
সেলিম: না। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন এবং পেশাগত জীবন আলাদা। একজন মানুষ হিসেবে, শিল্পী হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে আমাদের উচিত তার পাশে থাকা। পরীমনি বিষয়ে আমাদের এত জাজমেন্টাল হলে হবে না। কখন কার জীবনে কী ঘটে যেতে পারে, সেটা আমরা কেউ বলতে পারি না।
টিবিএস: আপনার বেশিরভাগ সিনেমায় গ্রাম, নদীসহ প্রকৃতির একটা দারুণ সম্পর্ক থাকে। অনুমান করা যায়, আপনার ছোটবেলাটা খুব বর্ণিল ছিল। ঠিক বললাম?
সেলিম: আমার জন্ম গ্রামে। ছোটবেলা কেটেছে ফেনীতে। গ্রামের নাম জাহানপুর। এটা ফেনী শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত ওখানেই কেটেছে। মানে বেড়ে উঠেছি আরকি। ওই সময় আমাদের গ্রামে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। একটা যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা। সব কাজিনরা মিলে দিনভর নানা কিছু করে বেড়াতাম। মজার ঘটনা হলো, আমাদের পরিবারের জীবনযাপন বা সংসারের জন্য যা যা দরকার, সবই আমাদের নিজেদের জোগাড় ছিল। হয়তো কেরোসিন তেল বা লবণটা বাজার থেকে কিনতে হতো। বাকিসব নিজেদের ক্ষেতে উৎপাদন হতো। কোনো জমিতে হয়তো পেঁয়াজ, কোথাও আদা, কোথাও ধান।
আমাদের বাড়ির সামনে একটা পুকুর ছিল, যেখানে প্রচুর পদ্ম ফুল ফুটত। সেগুলো তোলা ছিল আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমার ছোটবেলাটা একেবারেই গ্রামে কেটেছে। সিনেমায় এটার একটা প্রভাব তো পড়বেই।
টিবিএস: আপনার পড়াশোনা কি সেখানেই?
সেলিম: ক্লাস থ্রি পর্যন্ত জাহানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি। তারপর ক্লাস ফোরে এসে ভর্তি হই ফেনী পাইলট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে; তারপর ফেনী পাইলট স্কুল ও কলেজ। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই মার্কেটিং বিভাগে। তখন আর পড়াশোনা কি, সারাক্ষণ নাটক নিয়ে পড়ে থাকতাম। একেবারে প্রাকটিক্যাল থিয়েটার চর্চা যাকে বলে, সেটাই করেছি।
টিবিএস: ওই সময় তো নাটক লেখালেখিও শুরু করেন?
সেলিম: কৈশোরে কবিতা লিখতাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেশ কিছু পথনাটক লিখি। ওই সময় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর একটা অংশের নাট্যরূপ দিই। ওটা একটা দুঃসাহস ছিল। ওই সময় ঢাকা থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরও নাটকটি দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উনি বাসে যেতে পারবেন না; প্লেনে নিতে হবে। অত টাকা আমরা ওই সময় জোগাড় করতে পারিনি। পরে আর হয়নি।
টিবিএস: আপনি পড়াশোনো করেছেন মার্কেটিংয়ে। কিন্তু নির্মাণ করছেন চলচ্চিত্র। মার্কেটিং জগতে বিচরণ করতে না পারার জন্য দুঃখ হয় না?
সেলিম: একেবারেই না। আমি এখন যে প্রফেশনে আছি, সেটা খুব উপভোগ করি। এখন যদি কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করতাম, হয়তো বড় কোনো পোস্টে কাজ করতাম; কিন্তু সেটা কেমন হতো, আমি জানি না। আমার ওই অভিজ্ঞতা নাই। আমি সেটা চাইও না। এবং এটার জন্য কোনো দুঃখবোধও নাই।
টিবিএস: জীবনে কখন কোন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, মিডিয়াতেই স্থায়ী হবেন?
সেলিম: আমি যখন পড়াশোনো শেষ করে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসি, তখন সালাউদ্দিন লাভলু, মাসুম রেজা মিলে একটা অ্যাডফার্ম গড়ে তুলি। সেখানে কপি লিখতে লিখতে একটা অভিজ্ঞতা হয়। একদিন লাভলু ভাই বলেন, 'তোর তো লেখা ভালো, তুই টেলিভিশনের জন্য নাটক লেখা শুরু কর।' আমার প্রথম লেখা টিভি নাটক 'পৌনঃপুনিক'। পরিচালনা করেন কাওসার চৌধুরী। এটি প্রচারের পরপরই খুব আলোচনা শুরু হয়। বলতে পারেন, এক রাতের মধ্যে আমি তারকা নাট্যকারে পরিণত হই। তখনই আসলে সিদ্ধান্ত নেই চাকরি-বাকরি নয়, মিডিয়াতেই স্থায়ী হবো।
টিবিএস: আপনার প্রথম পরিচালিত নাটক ছিল 'বিপ্রতীপ'। কিন্তু আপনার তো ওই সময় পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না। কাজটা কঠিন মনে হয়নি?
সেলিম: এটা সাত পর্বের একটা নাটক। সত্যি কথা বলতে, ওই সময় আমাকে নাটকটা লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরিচালনা করার কথা ছিল নওয়াজিশ আলি খানের। কিন্তু পরে তিনি পরিচালনা করেননি। তখন মাসুম ভাই বললেন, 'তুই করে ফেল।' কিন্তু আমি তো ডিরেকশনের কিছুই জানি না। শুটিং কীভাবে করতে হয়, তাও জানি না। তবে আমার সৌভাগ্য, আমি ফার্স্ট এডি হিসেবে পেয়েছিলাম নূরুল আলম আতিককে। সেকেন্ড এডি সামির আহমেদ। জয়ন্ত ছিল প্রোডাকশন ম্যানেজার। অপু রোজারিও ছিল ক্যামেরায়। তারা সবাই তখন দেশের বাইরে থেকে সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছে। তাই ওদের নিয়ে কাজটা ঠিকঠাক হয়েছিল বলা যায়।
টিবিএস: গিয়াস উদ্দিন সেলিমের যেকোনো প্রোডাকশনে আলাদা সিগনেচার থাকে। এই আলাদা ব্যাপারটা কীভাবে তৈরি করলেন?
সেলিম: আসলে প্রত্যেকটা মানুষই আলাদা ও স্বতন্ত্র। যে মানুষটা ছবি আঁকেন, তিনি কিন্তু নিজের মতো করেই আঁকেন। যিনি কবিতা লিখেন, তিনি নিজের মতো করেই লিখেন। সবারই নিজের ভঙ্গি বা স্টাইল থাকে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। তবে আমি ভাগ্যবান, আমার স্টাইল বা ধরনটা মানুষ পছন্দ করেছে। এটাই আমাকে সাহস দিয়েছে সিনেমা বানানোর। নাটক নির্মাণের সাত বছর পর সিনেমায় হাত দিয়েছিলাম।
টিবিএস: আপনার প্রথম চলচ্চিত্র 'মনপুরা'। তারপর প্রায় ৯ বছরের বিরতি দিয়েছেন পরের সিনেমার জন্য। এটার কারণ কী?
সেলিম: কারণটা খুবই সিম্পল। আমি মাঝে 'কাজলরেখা' নামে একটা সিনেমা শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ অবধি বানাতে পারিনি। গো ধরে ছিলাম, এটাই বানাব। কিন্তু পরে একেবারে হাল ছেড়ে দিই এবং নতুন সিনেমা 'স্বপ্নজাল' বানানো শুরু করি।
টিবিএস: এখন কি নিয়মিত সিনেমা পাব আপনার কাছ থেকে?
সেলিম: আশা করছি। একের পর এক সিনেমা-হল বন্ধ হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, উল্টো নতুন সিনেমা-হল চালুরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন, সিনেপ্লেক্স চালু হচ্ছে। ওটিটি আছে। আশা তো করতেই পারি। ঘরে বসে সিনেমা দেখা যাবে। আমার তিন নম্বর সিনেমা 'পাপপূণ্য' সেন্সর হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি রিলিজ করব।