লঞ্চমালিক ও ঘাট ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ, শত শত শ্রমিক কাজ হারানোর আতঙ্কে

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের খুশিতে যখন সবাই উচ্ছ্বসিত, পদ্মার দক্ষিণ পারের দুই ঘাটের ব্যবসায়ী, স্পিডবোট ও লঞ্চচালক ও মালিক এবং ঘাটের শ্রমিকদের কপালে তখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। গেল দুই দিন ঘাটের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল মন্থর। অনেকটা বন্ধের পথে দুই ঘাটের হাজারো মানুষের আয়-রোজগারের পথ।
সোমবার ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে জমজমাট থাকা ঘাট এখন জনশূন্য। অনেক খাবার হোটেলের মালিক দোকানঘর বিক্রি করে দিচ্ছেন। অধিকাংশ ফলের দোকান বন্ধ। লঞ্চ, স্পিডবোট আর ফেরির পরিচিত শব্দ নেই। মুখরোচক খাবার বিক্রেতার হাঁকডাক নেই।
বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় দুশ্চিন্তায় ঘাট ব্যবসায়ী, স্পিডবোট ও লঞ্চ মালিক শ্রমিকরা। বেকার হয়ে পড়া এসব মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করে পুনর্বাসনের দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা।
ঘাট ইজারাদার ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুরের ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ঘাটে ৩৭টি খাবার হোটেল, ৩৯টি ফলের দোকান ও ৫৪টি চায়ের দোকানসহ ২১১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর শরীয়তপুরের সাত্তার মাদবর-মঙ্গলমাঝির ঘাটে ১১টি খাবারের হোটেল, ৭টি ফলের দোকান ও ২৯টি চায়ের দোকানসহ ১৪৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে।
ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ঘাট ও সাত্তার মাদবর-মঙ্গলমাঝি ঘাটে ৮৭টি লঞ্চ ও ২৫০টি স্পিডবোট চলাচল করত। এসব লঞ্চ ও স্পিডবোটে ১,১০০ মানুষ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। লঞ্চে টোল আদায়, ফেরিওয়ালা, মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে আরও ১ হাজার মানুষ।
পদ্মা সেতু চালুর ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে ঘাটনির্ভর এই মানুষগুলো।
ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ঘাটের হোটেল ব্যবসায়ী হাসান মোল্লা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই ঘাটে হোটেল ব্যবসা করি। আমার দোকানে কর্মচারী ছিল ১৭ জন। দৈনিক ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বেচাকিনি হতো। কর্মচারী ও সব খরচ বাদে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা লাভ থাকত। আমাদের যৌথ পরিাবর। ভালোই ছিলাম। এখন ঘাটে লঞ্চ, বোট কিছুই নাই। মানুষ আসে না, বেচাকিনি বন্ধ বলা যায়। আজ (সোমবার) সারা দিনে ৬ হাজার টাকা কেনাবেচা হইছে। কর্মচারী ১৫ জন বিদায় দিছি। এখন দেখছি ব্যবসাই বন্ধ হইয়া যাইব। কী কাজ কইরা খামু ভাবতে পারছি না।'
ফল ব্যবসায়ী শাহজালাল বলেন, 'ঘাটে বেচাবিক্রি ভালো ছিল। আমি নিজেই ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার ফল বিক্রি করতাম। গত দুই দিনে ঘাটে মানুষ নেই। রোববার ৫ হাজার টাকা বিক্রি করেছিলাম। সোমবার এখন পর্যন্ত ৩ হাজার বিক্রি হইছে। কয়েকটা দোকান ব্যবসা বন্ধ রাখছে। আমি কী করুম ভাবতাছি। এই এলাকায় মানুষ আসার কিছু সরকার কইরা দিলে বাঁচতে পারতাম।'
নাওডোবার আলামিন, ১২ বছর ধরে লঞ্চ থেকে যাত্রীদের মালামাল ওঠা-নামার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। অন্য সবার মতোই সেতু উদ্বোধনের খবরে খুশি তিনি। তবে নিজের ও পরিবারের একমাত্র আয়রোজগারের পথ নিয়েও চিন্তিত।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আলামিন বলেন, 'ঘরে আমার মা আর আমার ছোট বইন আছে। এই কুলিগিরি কইরা সংসার চালাই। কামাই করোনের মতন আর কেউ নাই। লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেলে কী করমু কইতে পারি না। মাছ ধরতে অইবো, নয়তো কৃষিকাম করমু।'
পানি বিক্রেতা সালাম শেখ বলেন, '২০ বছর যাবৎ পানি বিক্রি করে যাচ্ছি লঞ্চঘাটে আসা বিভিন্ন লঞ্চের তৃষ্ণার্ত যাত্রীদের কাছে। ভেবে পাচ্ছি না যাত্রীরা আর এই ঘাট দিয়ে না আসলে আমি কী কাজ করব। ভিটে-মাটি ছাড়া আর জমিও নেই যে চাষাবাদ করে খাব। সরকার যদি আমাদের রোজগারের একটা ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে আমরা দুই বেলা খেতে পারতাম।'
মাঝিরঘাটের হোটেল ব্যবসায়ী মোস্তফা মৃধা বলেন, '৩ মাস হইছে জমিন বেইচ্যা খাওনের হোটেল দিছি। আগে চাষাবাদ কইরা খাইতাম। বয়স অইছে, রইদের মধ্যে আর খেতে কাম করতে পারি না। একটা পোলা। বউ লইয়্যা আলাদা থাকে। আমারে খরচ দেয় না। আমি এত কষ্ট কইরা জমি বেইচ্যা হোটেল দিছি, অহন যদি পদ্মা সেতু হওনে এই ঘাটে মানুষ না আহে, তয় আমার হোটেলের চালান উঠব কেমনে! আমার তো অনেক লোকসান অইয়্যা যাইব।'
লঞ্চ মালিক লিয়াকত হোসেন বলেন, 'যৌথ মালিকানায় আমার ৭টি লঞ্চ রয়েছে। এসব লঞ্চে ৪৯ জন শ্রমিক কাজ করে। একেকটি লঞ্চে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার টাকা করে আয় হয়। প্রতিটি লঞ্চের সর্বনিম্ন মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু চালু হয়ে হঠাৎ করে লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের সংসার চলবে কী করে।'
লিয়াকত বলেন, শুধু লঞ্চমালিকরাই নন, বিপদে পড়েছেন লঞ্চের কেরানি, সুকানিসহ অন্যান্য কর্মচারীও। বিকল্প নৌরুট চালু করে লঞ্চ চালানোর দাবি জানান তিনি।
মাঝিরঘাটের ইজারাদার মোখলেছ মাদবর জানান, লঞ্চ ঘাটটি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২০ হাজার মানুষ পারাপার হয়। লঞ্চ ঘাটকে কেন্দ্র করে মাঝিরঘাট এলাকার গড়ে উঠেছে ছোটবড় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় লঞ্চ ঘাটটিতে চলাচল করা লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সবাই বেকার হওয়ার পথে।
এ এলাকায় পর্যটন বা রিসোর্ট করে কর্মসংস্থানের দাবি জানান মোখলেছ।