বর্ষায় আদমশুমারি: ছাতা, ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগের জন্য খরচ হবে ১২ কোটি টাকা

ট্যাবলেট কম্পিউটার (ট্যাব) কেনায় জটিলতায় প্রায় দেড় বছর পিছিয়ে ১৫ জুন জিরো আওয়ারে ভাসমান লোক গণনার মাধ্যমে শুরু হচ্ছে ষষ্ঠ জনশুমারি ও লোকগণনার কাজ। খানা পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলবে ২১ জুন পর্যন্ত।
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, এবার আষাঢ় মাসের প্রথম সাত দিন জনসংখ্যা গণনার কাজ করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
আবহাওয়া বিবেচনায় আগের পাঁচটি শুমারির তথ্য জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে সংগ্রহ করা হলেও প্রায় পাঁচ শতাংশ মানুষ গণনার বাইরে থেকেছেন। বর্ষায় তথ্য সংগ্রহ করার কারণে এবার আরও বেশি মানুষ গণনার বাইরে থাকবেন বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
বর্ষায় জনসংখ্যার তথ্য সংগ্রহে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গণনাকারীদের জন্য প্রায় চার লাখ ছাতা ও ট্যাবের সুরক্ষায় ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ কিনতে ১২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় করছে সংস্থাটি।
বর্ষার কারণে ছাতা কেনার পাশাপাশি দুর্গম এলাকায় পরিবহন ভাড়া ও বিভিন্ন খাতে সম্মানী বাড়িয়ে সম্প্রতি 'জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২১' প্রকল্প দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধন করা হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ও মেয়াদ অপরিবতর্তিত থাকায় একনেক সভায় না উঠিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সংশোধনী অনুমোদন দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের এপ্রিলে নেওয়া প্রকল্পের আওতায় গত বছরের শুরুতে মূল শুমারি পরিচালনার কথা থাকলেও করোনা অতিমারির কারণে তা পিছিয়ে যায়। অক্টোবরে আবার দিনকাল চূড়ান্ত হলে ট্যাব কেনা নিয়ে জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি।
প্রক্বলিত মূল্যের চেয়ে ১০৫ কোটি টাকা কম দামে ওয়ালটন ডিজি টেক ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড থেকে ট্যাব পাওয়া গেলেও সাশ্রয় হওয়া অর্থের পুরোটাই চলে যাচ্ছে ছাতা, ব্যাগ কেনাসহ বিভিন্ন খাতে।
শুমারি পরিচালনার কর্মীদের জন্য ছাতা কেনার বিষয়টিকে 'হাস্যকর ও অযৌক্তিক' বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।
শুমারির কাজ করার জন্য সম্মানীর বাইরে ব্যক্তিগত ব্যবহার্য পণ্য দেওয়ার যৌক্তিকতা নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, "সরকারের অনেক প্রকল্পে অনেক জনশক্তি কাজ করেন। বর্ষায় তাদের জন্য ছাতা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না।"
প্রকল্প সংশোধনী প্রস্তাবে আরও বলা হয়, নির্ধারিত সময়ে শুমারি শুরু না হওয়ায় তৃতীয় জোনাল অপারেশানের প্রয়োজন হচ্ছে। এ ছাড়া শুমারির ট্যাব ও সফটওয়্যার টেস্টিং, বিভাগ, সিটি করপোরেশান, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে শুমারি স্থায়ী কমিটির সম্মানী, এবং ছাতা সংগ্রহে অর্থ প্রয়োজন হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়েছে।
প্রকল্পের প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, দেশের উন্নয়নে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও রক্ষনাবেক্ষণের লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
তা ছাড়া জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি ও শিল্প পণ্যের চাহিদা নিরোপনের মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানির সিদ্ধান্তে এই শুমারির ফলাফলের তথ্য ব্যবহার হবে। শুমারিতে উঠে আসা তথ্য কাঠামো পরবর্তী অর্থনৈতিক শুমারি, কৃষি শুমারিসহ বিভিন্ন জরিপে ব্যবহার হবে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
গণনার বাইরে থাকা লোকের সংখ্যা বাড়বে
মূল শুমারি পরিচালনার সময় সারা দেশের আবহাওয়া অনুকূলে থাকবে বলে প্রকল্পটির অনুমিতিতে বলা হয়েছিল। তবে আষাঢ় মাসে আবহাওয়া অনুকূলে থাকার বিষয়ে অনেকটাই সন্দিহান অর্থনীতিবীদ ও পরিসংখ্যানবিদরা। এর ফলে অনেক মানুষ গণনার বাইরে থাকবে বলেও অনুমান তাদের।
সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, "আবহাওয়ার দিক বিবেচনায় এবার খুবই প্রতিকূল সময়ে শুমারির আয়োজন করা হচ্ছে। এর ফলে সরকারের বাড়তি অর্থ ব্যয় হবে। আবার বিপুল সংখ্যক মানুষ গণনার আওতার বাইরে থেকে যাবে।"
বৃষ্টিতে এই শুমারি পরিচালনা করা হলে চর, হাওড়, উপকূলবাসী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, ভাসমান লোকজনকে গণনার আওতায় আনা এবার কঠিন হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, "এসব লোকদের শুমারির আওতায় আনতে যে ধরনের প্রচার প্রচারণা দরকার তার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।"
তিনি আরও বলেন, "প্রযুক্তি অর্থাৎ ট্যাব ব্যবহার করে শুমারি পরিচালনার উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। তবে এই ট্যাব সংগ্রহ করতে সৃষ্ট জটিলতায় শুমারি বর্ষাকাল পর্যন্ত পেছানো ঠিক হয়নি।"
এর আগে ২০১১ সালের মার্চে পরিচালিত পঞ্চম আদমশুমারিতে ১৪ কোটি ২৩ লাখ মানুষ গণনা করেছিল বিবিএস। অধিকতর গণনায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) পায় ১৪ কোটি ৯৮ লাখ মানুষ। প্রায় ৭৪ লাখ ৫৩ হাজার বা পাঁচ শতাংশ মানুষ বিবিএসসের গণনার বাইরে থেকে যায়।
২০১১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পরিচালিত শুমারিতে বিবিএস ১২ কোটি ৪৪ লাখ মানুষের সন্ধান পেলেও বিআইডিএস এর যাচাইয়ে এই সংখ্যা দাড়ায় ১২ কোটি ৯৩ লাখে। ওই বছরও ৪৯ লাখ মানুষ গণনার বাইরে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (আইএসআরটি) অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাহাদাত হোসেন বলেন, "বৃষ্টির দিনে শুমারি পরিচালনা করে জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য পাওয়া কিছুটা কঠিন। তবে বিষয়টি বিবেচনায় পরিসংখ্যান ব্যুরো যে সমস্ত উদ্যোগ নিয়েছে, তা সফল হলে মোটামটি সঠিক জনসংখ্যা পাওয়া যাবে।"
তিনি আরও বলেন, "প্রতি এক দশকে শুমারি পরিচালনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটা করতে না পারলে যতই সময় যাবে, পরিসংখ্যানের মানের ততই অবনতি হবে।"
এ হিসাবে বাড়তি ব্যয় করে হলেও যে কোন মূল্যে সঠিক জনসংখ্যা নিরোপনের তাগিদ দেন তিনি।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ে পরিসখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দিন বলছেন, "বর্ষায় জনশুমারি করে প্রান্তিক মানুষের তথ্য সংগ্রহ কঠিন হবে। বিশেষ করে সিলেটের মত পাহাড়ি এলাকায় এটা অসম্ভব বলেও তিনি মন্তব্য করেন।"
যেভাবে বাড়ছে ব্যয়
শুরুর দিকে ওভারটাইম হিসেবে ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখলেও ১১৪.২৯ শতাংশ বাড়িয়ে তা ১ কোটি ৫০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
আপ্যায়ন বাবদ ব্যয় ১৬ কোটি ১১ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৬৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
হায়ারিং চার্জ খাতে ১০৭.৭৮ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে বলা হয়েছে, বর্ষা মৌসুমে তথ্য সংগ্রহ করা হবে বিধায় কতিপয় হাওড়, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বরিশালের দুর্গম ও নদীবহুল এলাকায় স্পীড বোট, ট্রলার ভাড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সেমিনার ও কনফারেন্স খাতে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকার বরাদ্দ দ্বিগুনে উন্নীত হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ২৯ লাখ টাকায়।
টিএ/ডিএ খাতে ৩১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বরাদ্দ দ্বিগুনের বেশি বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৬৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
অন্যান্য মনিহারি পণ্য খাতে ২৪.৬৪ শতাংশ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে ৫২ কোটি ১৬ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত প্রস্তাবে এ খাতে দেয়া হয়েছে ৬৫ কোটি ১ লাখ টাকা। মূলত ছাতা কিনতে বরাদ্দ দেওয়ায় এই ব্যয় বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিবিএস কর্মকর্তারা।
সম্মানী ও পারিতোষিক খাতে ৯ গুনের বেশি ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে ২ কোটি ৯ লাখ টাকার বরাদ্দ উঠেছে ১৯ কোটি ৬ লাখ টাকায়।
এছাড়া তথ্য সংরক্ষণ খাতে ৭৫ শতাংশ ব্যয় বাড়ছে।
২০১৯ সালের এপ্রিলে ১৭৬১.৭৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় একনেক। এ প্রকল্পে ১৮১.১১ কোটি টাকার বিদেশি সহায়তা অনিশ্চিত হয়ে গেলে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পের ব্যয় ১৫৭৫.৬৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। দ্বিতীয় সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় না বাড়িয়ে ট্যাব কেনায় সাশ্রয় হওয়া টাকা অন্যান্য খাতে দেওয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, "গত বছর শুমারি করার কথা থাকলেও আমরা কয়েকটি কারণে পিছিয়ে গেছি। কোভিডের কারণে আমরা প্রথম ধাক্কা খেয়েছি। এরপরে প্রকিউরমেন্টে আমরা হোঁচট খেয়েছি।"
তিনি বলেন, সরকারি ক্রয় সংক্রন্ত মন্ত্রীসভা কমিটিতে বাববার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে ট্যাব কেনা সময়ে সম্ভব হয়নি। এর ফলে শুমারি করতে বিলম্ব হয়েছে।
বৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে শুমারি আর পেছানোর সুযোগ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, "১০ বছর ব্যবধানে শুমারি পরিচালনায় বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় শুমারি আর পেছানো সম্ভব নয়।"