রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকেটে ভ্রমণ: তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য দিলেন অভিযুক্ত টিটিই
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণকারী যাত্রীদের জরিমানা করে টিকেট পরীক্ষকের (টিটিই) সাময়িক বরখাস্তের ঘটনায় তদন্ত শুরু হয়েছে। রোববার দুপুরে রেলের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ে সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা (এটিও) সাজেদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছেন তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি।
এদিকে রোববার সকালে রেল মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার ও আদেশ প্রদানকারী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়ায় আলোচিত এই ঘটনার নাটকীয় মোড় নিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে বিনা টিকিটে রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে ট্রেনে ওঠেন ইমরুল কায়েস প্রান্ত, হাসান ও ওমর নামের তিন যাত্রী। পথে টিকিট চেকিংয়ের সময় তাদের জরিমানা করলে রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার মনির ফোনে টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করেন বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়।
প্রথমে রেলমন্ত্রী নিজের আত্মীয় নয় বলে দাবি করলেও বিনা টিকেটের যাত্রী ও অভিযোগকারী প্রান্তের মা ইয়াসমিন আক্তার নীপার বক্তব্যে ভ্রমণকারীরা রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগনে ও মামাতো ভাই বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। পরে রবিবার সংবাদ সম্মেলনে ওই যাত্রীদের সাথে রেলমন্ত্রী আত্মীয়তার সম্পর্কের বিষয়টি স্বীকার করেন।
মন্ত্রীপত্নীর ফোন পেয়ে পাকশী বিভাগীয় বানিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে টিটিই শফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। তবে বিষয়টি মন্ত্রীপত্নী তাকে জানাননি বলে দাবি করেন রেলমন্ত্রী। একইসাথে কেন নাসির উদ্দিন টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করেছেন, তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়ার কথাও জানান মন্ত্রী।
এসব ঘটনার মধ্যে রোববার সকালে পাকশী বিভাগীয় রেলের কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির সাথে সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত হন অভিযোগকারী ইমরুল কায়েস প্রান্ত, টিটিই শফিকুল ইসলামসহ ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শী সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন। তদন্ত কমিটি দীর্ঘ সময় তাদের মৌখিক ও লিখিত বক্তব্য ও সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত শুনেন।
টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের কথা জানিয়ে শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় বানিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন জানান, টিটিই শফিকুল ইসলাম আইন বিষয়ে এলএলএম করেন। তার সকল বন্ধুরা জজ হিসেবে কর্মরত আছেন। কিন্তু তিনি ভালো একটি চাকরি পাননি বলে মানসিকভাবে খুব হীনমন্যতায় ভোগেন। কর্মস্থলে সহকর্মীদের সাথে অকারণেই চিৎকার চেঁচামেচি করেন। তার নিয়ন্ত্রণকারী (এসআরআই) সাধারণ ডিগ্রি পাস বলে তাকে তাচ্ছিল্য করতেন। মূলত তিনি তার মানসিক স্টিগমায় ভুগছেন। এই জন্যই তিনি যাত্রীসাধারণের সাথে বেশিরভাগ সময়ই অযাচিতভাবে খারাপ আচরণ করেন। একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্তের আগেই এ ধরনের বক্তব্যকে অনভিপ্রেত ও বিব্রতকর বলে মন্তব্য করেছেন পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহীদুল ইসলাম।
তিনি আরো বলেন, ব্যাক্তিগত দ্বন্দ্ব কিংবা অতি উৎসাহী হয়ে নাসির উদ্দিন বরখাস্তের আদেশ দিয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাকে দেওয়া কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব পাওয়ার পর এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তদন্ত কমিটির সাথে সাক্ষাতের পরে টিটিই শফিকুল ইসলাম বলেন, 'বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করায় আমি খুশি, শুকরিয়া আল্লাহর। যেহেতু আমি রেলওয়ের জন্য কাজ করি, দেশের জন্য কাজ করি, সেহেতু আমাকে কাজে যোগদানের সুযোগ দিয়েছে, এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।'
শফিকুল বলেন, 'এটাই আমার প্রথম সাময়িক বরখাস্তের আদেশ। ডিসিও স্যার কেন আমাকে মাদকাসক্ত ও মানসিক বিকারগ্রস্ত বললেন আমি তা বুঝতে পারছি না। যেদিন আমি ওই গাড়িতে দায়িত্ব পালন করেছি, সেদিন আপ অ্যান্ড ডাউনে ৭৮ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করে জমা দিয়েছি। বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে কি এমন কাজ করা সম্ভব? এই কথা বলে হতাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।'
এ ঘটনায় তদন্ত শুক্রবার রাতে গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যকাল তিন দিন বাড়িয়ে ৫ দিন করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান বিভাগী সহকারী পরিবহন অধিকর্তা সাজেদুল ইসলাম বাবু বলেন, 'আমরা অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তের বক্তব্য গ্রহনণকরেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য জানারও চেষ্টা করা হচ্ছে। অসদাচরণের ঘটনা ঘটেছে কি না সেটি নিশ্চিত হতে সকল বিষয় গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।' তদন্ত কমিটির ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই বলেও দাবি করেন তিনি।