নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস
ঢাকায় দ্বিতীয় শ্রেণীর (নার্স) চাকরি করেন জোহরা বেগম (৫৫)। দুই ছেলে, এক মেয়ে ও অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে তার সংসার। ৩২ হাজার টাকা মাসিক বেতনে একটু স্বাচ্ছন্দে থাকতে ঢাকার অদূরে সাভার থাকেন তিনি।
বাসা ভাড়া, ইউটিলিটি বিল, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার পর দৈনন্দিন বাজারের জন্য আট হাজার টাকা ব্যয় করতেন জোহরা। কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ওই একই বাজার এখন ১১-১২ হাজারে ঠেকেছে। সমানভাবে বেড়েছে অন্যান্য ব্যয়ও। ফলে এখন সাভারে থাকাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে জোহরা বেগমের জন্য।
জোহরা বেগম টিবিএসকে বলেন, "এভাবে সংসার চালানো সম্ভব নয়। এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতাম। সব কিছুর ব্যয় বাড়ায় এখন টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। জীবনে কখনো টিসিবির পণ্য না কিনলেও এখন বাধ্য হচ্ছি।"
বাংলামোটর এলাকার বাসিন্দা খালেদ হোসেন ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন বেসরকারি কোম্পানিতে। অর্ধেক টাকা গ্রামের বাড়ির অসুস্থ পিতামাতার জন্য পাঠাতে হয়। বাকি টাকা ঢাকায় বাসাভাড়া-খাবারের পেছনে ব্যয় করেন তিনি।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় টিকে থাকতে এখন টিসিবির পণ্য কিনছেন খালেদও।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমার জীবনে এতদিন টিসিবির পণ্য কিনতে হয়নি, কিন্তু আজ বাধ্য হচ্ছি কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার গ্রামের বাড়িতে আরো বেশি টাকা পাঠাতে হচ্ছে। আর এদিকে এই টাকা দিয়ে ঢাকায় চলাও সম্ভব হচ্ছে না।"
শুধু খালেদ কিংবা জোহরাই নয়, এখন টিসিবির পণ্য কিনতে ভিড় করছেন মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বহু মানুষ। তেল, চাল, ডাল, মাছ, মুরগি, ডিম, পেঁয়াজ, চিনি, গ্যাস ইত্যাদির দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ।
ফলে রাজধানীতে স্বল্প মূল্যে টিসিবির পণ্য পেতে মানুষের লাইন দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে, পণ্য পেতে টিসিবি গাড়ির পিছনে দৌড়াদৌড়ি-হুড়োহুড়ি এমকি মারামারির ঘটনাও ঘটছে, টিসিবি পণ্য না পেয়ে কাঁদতেও দেখা গেছে কাউকে কাউকে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যতালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পযন্ত অর্থাৎ গত দুই বছরে মোটা চাল ৩২ শতাংশ, সরু চাল ২৮, মোটা দানার মসুর ডাল ৬৩, চিনি ৩২, বোতলজাত সয়াবিন তেল ৫৫, খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৮৩ শতাংশ বেড়েছে।
দেশের ৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ। ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবার নেই। তাদের মধ্যে দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালকেরও একটি বড় সংখ্যা রয়েছে।
করোনাকালীন ২০২১ সালের ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২০ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পযন্ত পাঁচ মাসের একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা যায়, করোনাকালীন সময়ে দেশে মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। যাদের আয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা, তা আগস্ট মাসে এসে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বিবিএসের তথ্যে যা উঠে এসেছে, তার থেকেও মানুষ বেশি বিপদের মধ্যে আছে। বর্তমানে দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক।"
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য টিসিবিকে শক্তিশালী করতে হবে, ঢাকাসহ সারাদেশে টিসিবির গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে, সেই পণ্য যাতে কালোবাজারিদের হাতে না যায় তা কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।
রাজধানীর মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজারসহ বেশ কয়েকটি স্থানের খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৫৯ টাকা লিটার, ছোলা প্রতি কেজি ৭৫-৮০ টাকা, চিনি প্রতি কেজি ৮০-৮৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে বেশি বিপাকে পড়েছেন রাস্তায় খেটেখাওয়া মানুষেরা।
বাংলামোটর এলাকার একটি স্ট্রিট ফুডের দোকানে দুপুরের খাবার খেতে এসেছিলেন ফুটপাত ব্যবসায়ী হাদিউজ্জামান।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সব খাবারের জিনিসেরই দাম বেড়ে গেছে, শোল মাছ ৬০ থেকে ৮০ টাকা হয়ে গেছে, ৭ টাকার পরোটা ১০ টাকায় খেতে হচ্ছে। দৈনিক আয় নিজের খাওয়াতেই শেষ হয়ে যায়। পরিবারের জন্য কী পাঠাবো তা বুঝতে পারছি না।"
কাজে আসেনি ভ্যাট প্রত্যাহারের উদ্যোগ
ভোজ্য তেল, চিনি ও ছোলার উপর কর মওকুফের ঘোষণার পরেও বাজারগুলোতে পণ্যগুলোর দাম অপরিবর্তীত রয়েছে। সাথে সাথে বাজারে চাল, পিঁয়াজ, আলু, মশলার দাম বেড়েছে।
বিক্রেতারা বলছেন, শুক্রবার নতুন কোনো পণ্য কোম্পানিগুলো বাজারে সরবরাহ করেনি তাই আগের দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে পণ্য কেনাবেচার সময় ক্রেতা-বিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে তর্কেও জড়িয়ে পড়ছেন।
রাজধানীর আগারগাঁও তালতলা বাজারে মুদি দোকানে পণ্য কিনতে এসে সাবের হোসেন তেল, চিনি, ছোলার দাম গত সপ্তাহের মতোই দেখতে পেয়ে একপর্যায়ে দোকানী তানভীর হোসেনের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। তার প্রশ্ন এ তিনটি পণ্যের উপর কর মওকুফ করার পরেও কেন বাজারে দাম বেশি থাকবে।
সাবের হোসেন বলেন, "আমরা বিভিন্ন সময় দেখি দাম বাড়ানোর ঘোষণা হলেই বাজারে সকল পণ্যের দাম বেড়ে যায় এমনকি মোড়কের গায়ের মূল্য থেকেও বেশি দাম রাখে কিন্তু দু'দিন আগে কর মওকুফ করার পরেও এখন বলছে নতুন পণ্য বাজারে আসেনি।"
রাজা বাদশা স্টোরের তানভীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, "গত দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে তেলের সাপ্লাই কম। আমরা ক্রেতাদের এক বোতলের বেশি তেল দিতে পারছি না। একদিকে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম আবার দাম বেশি, এগুলো নিয়ে আমাদেরই হিমশিম খেতে হয়। আগামী রবিবারের দিকে নতুন প্রডাক্ট আসতে পারে তখন হয়তো দাম কমতে পারে। দাম বাড়তি কিংবা কম রাখা আমাদের হাতে নয়, সাপ্লাইয়ারদের হাতে।"
টিসিবির দেওয়া তথ্যমতে, গত ৬ মার্চ থেকে নবম দফায় সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, পবিত্র রমজান উপলক্ষে এক কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারকে (প্রতি পরিবারকে ২ বার) ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দেয়া হবে।
এদিকে রোববার থেকে ঢাকা মহানগরে প্রতিদিন ১৫০টি ট্রাকে পণ্য বিক্রি শুরু হবে। এ দফায় আগামী ২৪শে মার্চ পর্যন্ত শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন চলবে এ বিক্রয় কার্যক্রম। পরবর্তীতে ২৭শে মার্চ থেকে ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত পণ্য বিক্রি করা হবে। ঢাকা ছাড়া অন্য সব মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্রয় কার্যক্রম ১৫ই মার্চ থেকে শুরু হবে বলে জানায় টিসিবি।