‘স্বর্ণ চোরাকারবারী’ আবু আহাম্মদের অবৈধ ৭২১ কোটি টাকার প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি
হুন্ডি ব্যবসায়ী ও স্বর্ণ চোরাকারবারী আবু আহাম্মদের সম্পদ অনুসন্ধান করে অবৈধভাবে অর্জিত ৭২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার প্রমাণ পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এ বিষয়ে সম্প্রতি আদালতে একটি চার্জশিট দিয়েছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির টিবিএসকে বলেন, "এ মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এতে অবৈধভাবে অর্জিত ৭২১ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষে মোট ২১ জনেকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।"
২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি চট্রগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেটে অভিযান চালিয়ে তিনটি সিন্দুক থেকে ২৫০টি স্বর্ণবার ও ৬০ লাখ টাকা উদ্ধার করে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় আবু আহাম্মদ ও এনামুল হককে আসামি করে স্বর্ণ চোরাচালান মামলা দায়ের করে পুলিশ। সে বছর ২৮ জুন স্বর্ণ চোরাচালানের এ মামলায় আবু আহম্মদসহ ৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় ডিবি পুলিশ।
এরপর তাদের অবৈধ সম্পদের প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। পরে ২০২০ সালের মার্চে ২০ জনকে অভিযুক্ত করে অর্থপাচার আইনে মামলা দায়ের করে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।
এতে অভিযুক্তরা হলেন- আবু আহাম্মদ, ইকবাল মোহাম্মদ, আবু রাশেদ, এসএম আসিফুর রহমান, মো. ওবায়েদুল আকবর, মো. রফিক, মোহাম্মদ জিয়া বাবলু, ইমরানুল হক মো. কপিল চৌধুরী, এমতিয়াজ হোসেন, মোহাম্মদ আলী, ফরিদুল আলম, মোহাম্মদ এরশাদল আলম, মো. হাসান, রুবেল চক্রবর্তী, মো. মিনহাজ উদ্দিন, সাগর মহাজন, দিনবন্ধু সরকার, মো. আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মো. শাহজাহান, টিটু ধর।
পরে তদন্তে খোরশেদ আলম নামের আরও একজনের সংশ্লিষ্টতা পায় সিআইডি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত আবু আহাম্মদ তার চট্রগ্রামের ফটিকছড়ির জাহানপুর গ্রামের বাসিন্দা হাজি ফয়েজের ছেলে। একসময় তার পিতার সিগারেটের দোকান ছিল। এরপর তিনি গ্রামে মুড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একপর্যায়ে দুবাইয়ে চলে যান তিনি। এরপর স্বর্ণ চোরাচালান ও অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায়ে জড়িয়ে পরেন।
এরপর আবু আহাম্মদ হুন্ডি ব্যবসার জন্য নিজের নামে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ২১ টি ব্যাংক হিসাব খোলেন। এরমধ্যে রয়েছে- ফরহাদ ট্রেডিং, রিয়াল ট্রেডিং, নাইস টেলিকম সেন্টার, রুপা টেলিকমিউনিকেশন, রিয়েল ট্রেডিং, এমএস ওয়ার্ল্ড সেন্টার, ফরহাদ ট্রেডিং এবং এবি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযুক্তরা ছাড়াও বিভিন্ন পেশার মানুষ বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন করেছেন।
অভিযুক্ত খোরশেদ আলম সৌদি আরব থেকে দেশে টাকা পাঠাতে চায় এমন প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন। তার ছোট ভাই ফরিদুল আলম, আবু আহাম্মদের কাছ থেকে চেক নিয়ে টাকা উত্তোলণ করে খোরশেদ আলমের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে থাকা প্রবাসীদের আত্মীয়দের কাছে পৌছে দিতেন। আবু আহাম্মদ এভাবে খোরশেদ আলমের মতো অজ্ঞাতানামা একাধিক ব্যক্তিকে তার এই হুন্ডি ব্যবসায় যুক্ত করেছিলেন।
এভাবে প্রবাসীদের টাকা রেমিটেন্স হিসেবে দেশে না পাঠিয়ে বিদেশে রেখে সেই টাকা অবৈধ স্বর্ণ চোরাচালানের কাজে ব্যবহার করেছে। অর্থপাচার আইনে করা মামলার তদন্ত করেছেন সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের ইস্পেক্টর মোহাম্মদ সাদেক আলী।
অভিযুক্ত আবু আহাম্মদ দেশি বিদেশি মুদ্রা পাচার, স্বর্ণ চোরাচালান ও অন্যন্য চোরাই দ্রব্যের ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তিনি চট্রগ্রাম শহর ও ফটিকছড়িতে একাধিক ভবন ও মূল্যবান জমি ক্রয় করেছেন। এছাড়া চট্টগ্রামের কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় ৩৩ নম্বর প্লটে প্রায় ১৬ কাঠা জমির ওপর বাড়ি, পাঁচলাইশ হিলভিউ আবাসিক এলাকায় ছয়তলা ভবন, ফতেহনগর রাউজানে পল্লী কাকন ও পল্লী শোভা ম্যানশন নামে বাড়ি আছে তার। অবৈধ টাকায় দুবাইয়ে ৩ টি দোকান রয়েছে বলেও জানা গেছে।
এছাড়া আবু আহাম্মদের বিরুদ্ধে ডিএমপির বিমানবন্দর থানায় স্বর্ণ চোরাচালানের মামলা রয়েছে। এ মামলায় ১০৫.৪০ কেজি ওজনের ৯০৪টি স্বর্ণের বার ও ৪৭ কোটি ৪৪ লাখ ১০ হাজার টাকার উদ্ধারের তথ্য রয়েছে। ডিএমপির পল্টন থানায় স্বর্ণ চোরাচালানের অন্য একটি মামলায় ৬১.৫৩৮ কেজি ওজনের ৫২৮ টি স্বর্ণ বার ও ৩ কোটি ৫৮ হাজার সৌদি রিয়েল, ৫ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা উদ্ধারের তথ্য রয়েছে।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও নগদ অর্থ জব্দের পর সে মামলায় আবু আহাম্মদকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে তিনি তথ্য গোপন করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে একই বছরের আগস্টে কারাগার থেকে বের হন। তারপর হাইকোর্টের দুই বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে স্বর্ণ চোরাচালান মামলার কার্যক্রম স্থগিতের বিষয়ে একটি পিটিশন তৈরি করেন। সেটি ৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি শাখায় প্রেরণ করা হয়। পরে তা বিচারিক আদালতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
জালিয়াতির এ ঘটনাটি ধরা পড়ার পর হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ২০১৬ সালের নভেম্বরে আবু আহাম্মদসহ জড়িত আরও দুইজনের নাম উল্লেখ করে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন।