বগুড়া বক্ষব্যাধি হাসপাতাল: যার ইনডোর ও আউটডোরের মধ্যে দূরত্ব ৪ কিলোমিটার!
বগুড়া বক্ষব্যাধি ২০ শয্যার হাসপাতালে বর্তমানে ১০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। কারও বাড়ি বগুড়া। কেউবা এসেছেন জয়পুরহাট থেকে। অথচ ৩ বছরের বেশি হলো হাসপাতালে পদায়নকৃত কোনো চিকিৎসক নেই। এ কারণে রোগীদের দেখাশোনা করার জন্য এখানে অন্য উপজেলায় পদায়নকৃত এক মেডিকেল অফিসারকে সংযুক্তিতে রাখা হয়েছে। তিনিও ঢাকার বারডেম হাসপাতালে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছেন। চিকিৎসক ঢাকায় গেলে রোগীদের নির্ভর করতে হয় সেবিকাদের উপরই।
জানতে চাইলে হাসপাতালে পদায়নকৃত চিকিৎসক এমদাদুল হক বলেন, "চিকিৎসক সংকটের কারণে তো সমস্যা হয়ই। আরেকজন চিকিৎসক থাকলে বেশি সুবিধা হতো। তবে আমি ঢাকা বা ছুটিতে গেলে অন্য চিকিৎসককে এখানে দায়িত্ব দেওয়া থাকে।"
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকিৎসক উপস্থিত না থাকলে রোগীদের নার্সরাই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স আমেনা খাতুন জানালেন, চিকিৎসক সংকটের কারণে সমস্যা শুধু রোগীদের নয়, তাদেরও। হঠাৎ কোনো রোগীর শারীরিক সমস্যা বেশি হলেও কোনো ওষুধ দেওয়া যায় না। ওই সময় মুঠোফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে গেলেও পাওয়া যায় না। হাসপাতালে কোনো রোগী মারা গেলে চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া মৃত্যু সনদও কেউ দিতে পারেন না।
ভর্তি হতে গেলেও রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। কারণ এই হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরের মধ্যে দূরত্ব অন্তত ৪ কিলোমিটার। সেখানেই প্রথমে রোগীকে ভর্তির জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়।
বগুড়া সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার একমাত্র বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ২১টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে দু'জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও পদায়নকৃত কোনো চিকিৎসক নেই। শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. এমদাদুল হককে এখানে সংযুক্তি দেওয়া রয়েছে। এর আগে ওই হাসপাতাল থেকে ৮ মাস আগে (২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর) ছেড়ে গেছেন চিকিৎসক এহসানুল কবির। তিনি এখন নওগাঁ মেডিকেল কলেজে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে ওই সময় নথিতে এই হাসপাতালে চিকিৎসক তানজিলা সুলতানা নামের একজন চিকিৎসকের নাম ছিল।
২০১৭ সাল থেকে তিনি প্রেষণে ঢাকায় কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে ছিলেন। তবে তিনি বগুড়ার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকেই বেতন-ভাতা নিতেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরুরি আদেশে তাকে বদলি করা হয়। ওই সময় এই হাসপাতাল তথা ঠনঠনিয়ায় অবস্থিত বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ মিত্র। এখন তিনিও নেই। এক বছর হলো তিনিও অবসরে গেছেন।
রাজশাহী স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগে মাত্র তিনটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে একটি রয়েছে রাজশাহীতে। অন্যটি পাবনায়। আরেকটি বগুড়ায়। বগুড়ার এই হাসপাতালের জন্য ১৯৬০ সালে ৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। স্থাপনা নির্মাণ করা হয় ১৯৬১ সালে। ওই সময়ে ২ জন চিকিৎসকসহ ১৬ জনের পদ সৃষ্টি করা হয়। হাসপাতাল নির্মাণের ৬০ বছর পার হলেও সেখানে চিকিৎসক সংখ্যা এখনো বাড়েনি। তবে শুরুতে ৩ জন নার্স থাকলেও এখন সেখানে রয়েছে ৮ জন। এই বৃদ্ধিতেই হাসপাতালের পদ সংখ্যা এখন ২১।
বগুড়ার হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকায় ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হয় রোগীদের। সম্প্রতি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, শহরের নিশিন্দারা এলাকায় অবস্থিত হাসপাতালে কোনো কোলাহল নেই। হাসপাতালজুড়ে রয়েছেন কয়েকজন সেবিকা। ওয়ার্ডে ১০ জন রোগী ভর্তি। একদিন আগে এখানে সংযুক্তিতে থাকা চিকিৎসক রোগীদের দেখে পরামর্শ দিয়েছেন। সেই পরামর্শ মতে ওষুধ দিচ্ছেন তারা।
দেড় বছর ধরে এই হাসপাতালে রয়েছেন আমেনা খাতুন (ছদ্মনাম)। জানালেন, এই হাসপাতাল এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলছে। চিকিৎসক সংকটে বেহাল। আগে এক সময় গড়ে ২০ থেকে ২৫ জন রোগী নিয়মিত থাকতো। এখন অনেকে ফিরে যান। চিকিৎসক সংকটের কারণে এখানে ভর্তি হতে ভয় পান মানুষ।
কথা হয় হাসপাতালে ভর্তি সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তার বাড়ি বগুড়ার নিশিন্দারা এলাকাতেই। তিন মাস আগে বুকের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানালেন, "সেবিকাদের সেবার কোনো ঘাটতি নেই। তবে চিকিৎসক রয়েছেন একজন। তিনিই সবগুলো রোগীকে দেখাশোনা করেন। চিকিৎসক ছুটিতে থাকলে নার্সরাই আমাদের দেখাশোনা করেন।"
শহরের বাসিন্দা গোলেদা বেগম শ্বাসকষ্ট নিয়ে ১২ দিন আগে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি হওয়ার পর কিছুটা আরামে রয়েছেন এই নারী। জানালেন, তিনি আসার পর অবশ্য দেখেছেন এখানে দুয়েকদিন পরপরই সকালে চিকিৎসক আসেন। কিছুক্ষণ হাসপাতালে থাকার পর তিনি চলে যান। এরপর সেবিকারাই তাদের দেখাশোনা করেন।
এর বাইরে ভিন্ন রকমের সংকটও রয়েছে। বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আউটডোর (ক্লিনিক) ও ইনডোর (হাসপাতাল) অন্তত ৪ কিলোমিটার দূরে হওয়ার এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হন।
চার মাস আগে নওগাঁ শহরের এক রোগী মামুনুর রশিদ (৪৮) শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হতে এসেছিলেন নিশিন্দারার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। নওগাঁ থেকে সেখানে আসতেই তার দুপুর ১২টা পার হয়ে যায়। কোনো রোগী সরাসরি হাসপাতালে গেলে তার ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই। ভর্তি হতে গেলে বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের সুপারিশ লাগবে। দুপুর ১টার দিকে মামুনুর এসে দেখেন বক্ষব্যাধি ক্লিনিক এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ এই আউটডোর খোলা থাকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত।
মামুনুর বলেন, "এমন বিরক্তির কারণে আর ভর্তি হওয়া হয়নি। ভাবছি আবার ভর্তি হতে যাব।"
এভাবে এসে ভোগান্তির শিকার হন অনেকেই। এটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানে। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ভোগান্তির কথা স্বীকারও করেছেন হাসপাতালে ১৪ বছর ধরে ফার্মাসিস্টের দায়িত্ব পালন করা মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের এমন দূরত্বের কারণে অনেকেই ভর্তি না হয়ে চলে যান।
মোয়াজ্জেম আরও বলেন, "কয়েক বছর ধরে দেখছি হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সাধারণত পদায়ন বা সংযুক্ত হয়ে থাকেন না। বিশেষ করে নবীন চিকিৎসকেরা আসেন। তারা এখানে থেকে বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হন। পড়াশোনা করে অন্যত্র চলে যান। ফলে এখানকার চিকিৎসক সংকট কখনো মেটে না।"
বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে ২ জন কনসালট্যান্টসহ মোট ১৭টি পদ রয়েছে। তবে এখন কর্মরত রয়েছেন ১১ জন। এর মধ্যে একজন মেডিকেল অফিসার কনসালট্যান্টের (জুনিয়র কনসালট্যান্ট) দায়িত্বে রয়েছেন। ২ বছর ধরে এখানে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক ডা. মোছা. আয়েশা সিদ্দিকা জানান, বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে সাধারণত রেফার করা রোগীরা আসেন। ক্লিনিকে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, "ক্লিনিকে আরেকজন চিকিৎসক না থাকার কারণে সমস্যা তো হওয়ার কথা। অনেক সময় রোগীরা ফিরে যান। তবে এই সংখ্যা খুব বেশি নয়। কারণ অন্যসব হাসপাতালের মতো বক্ষব্যাধি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে খুব বেশি জরুরি রোগী থাকেন না।"
জানতে চাইলে বগুড়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মাদ শফিউল আজম বলেন, "এই বিষয়টি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবাই অবগত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে, এখানে একজন মেডিকেল কর্মকর্তা দেওয়ার জন্য। তবে আপাতত সংকট সমাধানের জন্য শিবগঞ্জের এক মেডিকেল কর্মকর্তা সেখানে প্রতিদিন সকালে রোগীদের দেখাশোনা করেন। এর বাইরে বগুড়ার ঠনঠনিয়ায় অবস্থিত বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে একজন চিকিৎসক রয়েছেন।"