খুলনায় পরিবেশবান্ধব শিল্পোন্নয়নে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা
দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুলনা বিভাগের টেকসই উন্নয়ন, সুন্দরবনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাগুলোর মাঝে সমন্বয়ের ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। বুধবার সকালে দ্য বিজনেস স্যান্ডার্ড আয়োজিত 'খুলনা অঞ্চলের শিল্পায়ন: সমস্যা-সম্ভাবনা' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এ কথা বলেন সংশ্লিষ্টরা।
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ আহরণ, নেপাল ও ভূটানের সঙ্গে মোংলা বন্দরের কানেক্টিভিটি তৈরি, খুলনা নিজউ প্রিন্ট, জুটমিল, হার্ডবোর্ড মিল ও টেক্সটাইল সচল করার পাশাপাশি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে মোংলা পর্যন্ত এক্সপ্রেস ওয়ে তৈরি করাও এখন সময়ের দাবি। এছাড়াও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঢাল হিসেবে সুন্দরবনকে ব্যবহার না করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এর সংরক্ষণ, এ অঞ্চলে নোনা পানির পরিবর্তে পর্যাপ্ত সুপেয় পানির যোগান, নগরে গ্যাস সংযোগ দেওয়া ও আধুনকি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন সমন্বয় দরকার বলেও মত দিয়েছেন খুলনার বিশিষ্টজনেরা।
ওয়েবিনার টি পরিচালনা করেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক ইনাম আহমেদ।
ওয়েবিনারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, "খুলনা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি জায়গা; এবং পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবনও এখানে অবস্থিত। তাই শিল্প ও উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভবানা রয়েছে এখানে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নাগরিকদেরও এই উন্নয়ন কাজে এগিয়ে আসতে হবে; পাশাপাশি সরকার এখানে সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।"
তিনি আরও বলেন, "খুলনায় এখন সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে, এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।"
"খুলনা অঞ্চলে পরিবেশ বান্ধব দীর্ঘমেয়াদী শিল্পায়ন দরকার, যেখানে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থানা থাকবে। নতুন শিল্পায়নে পরিবেশ অধিদপ্তরকে যাচাই-বাচাই করতে হবে, যাতে কেউ অসৎ উপায়ে এবং ভালো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়া শিল্পায়নের অনুমতি না পায়", আরও যোগ করেন তিনি।
সব মিলিয়ে এসব উন্নয়নে সবাইকে রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে এসে উন্নয়ন কাজ সমন্বয় আহ্বান জানিয়েছেন অধ্যাপক হারুন চৌধুরী।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ হুমায়ন কবির বলেন, "বাংলাদেশে দুটি নদী বন্দরের একটি খুলনায়; কিন্তু স্বাধীনতার পরে আমরা এই বন্দরের সুযোগটি ধরে রাখতে পারিনি। খুলনা নিউজ প্রিন্ট, জুটমিল,হার্ডবোর্ড মিল, টেক্সটাইল এগুলোও আমরা ধরে রাখতে পারিনি।"
তবে পরবর্তী হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি, খুলনার শিল্পক্ষেত্রে কিছুটা আশার জাগিয়ে রাখলেও, আমেরিকার ভেনামি চিংড়ি বাংলাদেশের চিংড়ির বাজার দখল করে নিয়েছে বলে বলে জানান হুমায়ন কবির।
তিনি বলেন, "বর্তমানে চিংড়ি রপ্তানিতে ২য় স্থান থেকে পিছিয়ে আমাদের অবস্থান এখন ৭-তে চলে গিয়েছে। তাই আমাদেরও ভেনামি চিংড়ি চাষ করার চিন্তা করতে হচ্ছে। খুলনা অঞ্চলের গলদা ও বাগদা চিংড়ির জায়গায় এখন ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করতে হবে।"
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র আলী আকবর টিপু বলেন, "জলবায়ুর দিক থেকে আমাদের খুলনা পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল; এ বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "খুলনা অঞ্চলের শিল্পোন্নয়নের জন্য কোনো সমন্বিত পরিল্পনা নেই। তাই যেখানে সেখানে কল-কারখানা গড়ে উঠছে, ময়লা-আবর্জনা নদীতে পড়ছে এবং পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। সব মিলিয়ে পরিবেশের দিক থেকে খুলনা মারত্মক অবস্থান পৌঁছেছে।"
খুলনা চেম্বার অফ কমার্সের পরিচালক মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, "মোংলা সমুন্দ্রবন্দর এবং বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দরের কারণে বাংলাদেশের তৃতীয় বহত্তম শহর খুলনা অর্থনৈতিকাভাবে খুবই সম্ভাবনাময়।"
আগে এ অঞ্চলের উন্নয়ন থেমে থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খুলনা অঞ্চলের উন্নয়ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
টুটুল আরও বলেন, "সরকার যদি নেপাল ও ভূটানকে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে তাহলে এই তিনটি বন্দরের মাধ্যমে খুলনা অঞ্চলের ব্যাপক শিল্পায়ন সম্ভব হবে। শিল্পোন্নত নগরী হিসেবে খুলনার ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে।"
টুটুল জানান, ভাঙ্গা থেকে মোংলা পর্যন্ত এক্সপ্রেস ওয়ে তৈরির দাবি করেছেন তারা। কারণ পদ্মাসেতু চালু হলে সেতুতে যানজট তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে মোংলা বন্দরের ৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে; তবে এক্সপ্রেসওয়ে বনানো হলে এই বন্দরটি সম্পূর্ণভাবে সচল ও কার্যকর হয়ে উঠবে।
একই সঙ্গে খুলনায় গ্যাস সংযোগ ও খানজাহান আলী বিমানবন্দরের কাজ শুরু করারও প্রস্তাব জানিয়েছেন তারা। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে এ এলাকার সম্ভাবনাকে কাজ লাগানো সম্ভব বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সাংবাদিক এবং পরিবেশকর্মী গৌরাঙ্গ নন্দী জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের উদ্বেগজনক পরিণতি হিসেবে খুলনা অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
তিনি বলেন, "রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, শিল্পনগরী হিসেবে খুলনা তার পুরানো গৌরব হারিয়ে ফেলেছে।"
উদ্যোক্তাদের চাহিদা মেটাতে স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে নতুন শিল্প গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
খুলনার নারী উদ্যোক্তা শামীমা সুলতানা শিলু বলেন, বোতাম ও ওয়ানটাইম কাপ-প্লেটের মতো উদ্ভাবনী পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে নারকেল ও সুপারির বর্জ্য ব্যবহার করা যেতে পারে। যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে স্থানীয় নারীর এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।
আরেক নারী উদ্যোক্তা তামান্না তাবাসসুম শোভা বলেন, "খুলনা নারী উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্যও একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল।" নারীদের জন্য তিনি বিশেষ উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছেন, যেন সম্ভাবনাগুলোকে ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়।