বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় মেট্রোরেলের নিরাপত্তা ও বিমা নিয়ে উদ্বেগ
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোরেলে একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। এর ফলে আগারগাঁও থেকে মতিঝিলে পর্যন্ত ১১ ঘণ্টা বন্ধ থাকে ট্রেন চলাচল। এ ঘটনায় বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিরল হলেও এ ঘটনাকে চিন্তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, নকশাগত ত্রুটির কারণে এটি হতে পারে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, 'ট্রেন যে স্থানে বাঁক নেয়, সেখানে অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে গেছে। সাধারণত বেশি চাপ পড়ে যেসব স্থানে, সেখানে বিয়ারিং প্যাড ঠিক রাখতে ক্ল্যাম্প ও নাট-বল্টু ব্যবহার করা হয়।'
'নকশাটি এ বিষয়টিতে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া দেয়নি। এ কারণে অতিরিক্ত চাপে বিয়ারিং প্যাড আলগা হয়ে পড়ে,' বলেন তিনি।
এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে হাদিউজ্জামান বিয়ারিংগুলোকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি আরও টেকসই উপকরণ, যেমন রাবারের বদলে ধাতব পড বিয়ারিং ব্যবহারের পরামর্শও দেন।
বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনার পর ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে।
কমিটির একজন সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার ঘটনাটি বিরল হলেও এটি নকশাগত ত্রুটির কারণেই হচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। কমিটি ঘটনাস্থলের চাপ ও চলাচল মনিটর করতে ক্যামেরা স্থাপনের সুপারিশ করেছে।
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
ঘটনাটি মেট্রোরেলের নিরাপত্তা প্রটোকলের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। কারণ, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সনদ ছাড়াই প্রায় দুই বছর ধরে পরিষেবাটি পরিচালনা করছে ডিএমটিসিএল।
মেট্রোরেলের কার্যক্রম শুরুর আগে সনদ গ্রহণের জন্য স্বতন্ত্র তৃতীয় পক্ষের কোনো সংস্থাকে নিয়োগ দিতে নির্দেশনা দিয়েছিল ডিটিসিএ। কিন্তু সে কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি।
মেট্রোরেল আইন-২০১৫ ও মেট্রোরেল বিধিমালা-২০১৬ অনুযায়ী, ডিটিসিএর কাছে নিয়মিত নিরাপত্তা প্রতিবেদন জমা দিয়ে সব ধরনের কারিগরি ও নিরাপত্তাবিষয়ক অনুমোদন নেওয়ার কথা ডিএমটিসিএকের। তবে ডিটিসিএর কর্মকর্তারা বলছেন, মেট্রোরেল চালুর পর থেকে ডিএমটিসিএল একটি নিরাপত্তা প্রতিবেদনও জমা দেয়নি।
ডিটিসিএর কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য তারা ডিএমটিসিএলকে বিভিন্ন সময়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। এছাড়া মেট্রো পরিষেবা শুরুর আগে এক সভায় তৃতীয় পক্ষের নিরাপত্তা সনদ ও অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়ও উপস্থাপন করা হয়েছিল।
কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ডিএমটিসিএল এখনও নির্মাণ পরিকল্পনার জন্য ডিটিসিএ থেকে অনুমোদন পায়নি। যদিও আইন অনুযায়ী অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তবে রাজনৈতিক চাপে এ বিষয়ে কিছু করা সম্ভব হয়নি বলে মন্তব্য করেন তারা। এর বেশি কিছু জানাতে রাজি হননি কর্মকর্তারা।
পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটি মেট্রোরেল ও এর যাত্রীদের বিমাও করেনি। এছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা হলে ক্ষতিপূরণের কোনো নীতিও প্রণীত হয়নি।
ডিটিসিএর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অনেকবার চিঠি চালাচালির পরও ডিএমটিসিএল এসব নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়গুলো সুরাহা করতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
গত মাসে এমএএন ছিদ্দিকের স্থানে আসা নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ কিছু নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, তারা সমস্ত আইনগত বাধ্যবাধকতা মেটাতে কাজ করছেন।
মন্তব্যের জন্য গতকাল (১৩ অক্টোবর) এমএএন ছিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
নিরাপত্তা উদ্বেগের সমাধান করতে কাজ করছে ডিএমটিসিএল
চলতি মাসের গোড়ার দিকে টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে মোহাম্মদ আবদুর রউফ নকশাগত ত্রুটির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, এ বিষয়ে এখনও বিশদ তদন্ত চলছে।
তিনি বলেন, 'নকশাগত ত্রুটির কারণে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে গেছে—এই দাবির সঙ্গে আমরা একমত নই। বিভিন্ন কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।'
আবদুর রউফ আরও বলেন, ডিএমটিসিএল এমন একটি ব্যবস্থা তৈরিতে কাজ করছে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়। এছাড়া নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগ সমাধানের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
নিরাপত্তা সনদ প্রসঙ্গে রউফ বলেন, সিস্টেমটি স্থাপন করেছে একটি জাপানি কোম্পানি। ওই কোম্পানিই একটি নিরাপত্তা সনদ দিয়েছে। তবে আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকায় ডিএমটিসিএল তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিতে উদ্যোগ নিয়েছে।
নিয়মিত নিরাপত্তা প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করেন তিনি। তবে এ প্রক্রিয়া চলতি মাস থেকেই শুরু হবে বলে আশ্বস্ত করেন ডিএমটিসিএলের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
বিমা প্রসঙ্গে রউফ বলেন, বিমা কাভারেজ ও ক্ষতিপূরণ নীতিমালা প্রণয়নের জন্য ডিএমটিসিএল বাংলাদেশ জীবন বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ডিফেক্ট লাইয়েবিলিটি পিরিয়ডে—যা নির্মাণ-পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত চলবে—যেকোনো কারিগরি ত্রুটির জন্য ক্ষতিপূরণের দায় ঠিকাদারের ওপর। আর ভবিষ্যতে জরুরি পরিস্থিতির জন্য একটি আনুষ্ঠানিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।