‘কেউ খোঁজ নেয়নি’: ২ শতাধিক স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে বিছানায় দিন কাটছে কুষ্টিয়ার সুমনের
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দুই শতাধিক ছররা গুলি (স্প্লিন্টার) সুমনের শরীরে ঢুকে যায়। সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও বিনা চিকিৎসায় কর্ম খুইয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় বিছানায় দিন পার করছেন তিনি।
সুমন ব্যাপারি (১৮) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের হাসিমপুর বাজার সংলগ্ন আলী হোসেনের বড় ছেলে। পরিবারের অনটনের কারণে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করে কুষ্টিয়ার একটি বেকারিতে হাজিরাভিত্তিক ডেলিভারির কাজ করতেন তিনি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে সুমন কর্মবিরতি দিয়ে ১ আগস্ট থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলনে অংশ নেন। ৫ আগস্ট বেলা ১২টার দিকে কুষ্টিয়া মডেল থানার গেটের সামনে গোলাগুলি হয়।
সুমনের ভাষ্যে, সে সময় তার সামনে সবুজ নামক এক ব্যক্তি পুলিশের ছোড়া বুলেটে মারাত্মকভাবে আহত হন। সবুজ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সুমন তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করতে গেলে অসংখ্য ছররা গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
তাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছয় দিন চিকিৎসাশেষে আড়াইশয়ের বেশি ছররা গুলি শরীরে নিয়ে বাড়ি ফেরেন সুমন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পরে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দুমাস হলেও চিকিৎসার জন্য কোনো সহায়তা পাননি বলে জানান সুমন। এমনকি এখন পর্যন্ত কেউ তাকে দেখতেও আসেননি।
সুমন বলেন, '৫ তারিখ বেলা ১২টার দিকে কুষ্টিয়া মডেল থানার গেটের সামনে পুলিশের ছোড়া গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সবুজ নামক এক ব্যক্তি।
'রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে আমি শরীরে [ছররা] গুলিবিদ্ধ হই। তারপর টিয়ারশেলের ধোঁয়া আমার সামনে এলে আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালের বিছানায়।'
হাসপাতালে থাকার সময় কেবল তার কর্মস্থলের পক্ষ থেকে একদিন শুধু তাকে দেখতে যাওয়া হয়েছিল জানিয়ে সুমন বলেন, 'তারপর থেকে প্রায় দুই মাস হতে চলল, আর কেউ খোঁজ নেয়নি।'
'ডাক্তার বলেছে আমার শরীরে আড়াইশর বেশি স্প্লিন্টার রয়েছে। এতগুলো বের করা অনেক ব্যয়বহুল হবে। এখন আমি দাঁড়াতে পারি না, হাঁটতে পারি না, বসলে পিঠে ব্যথা করে।'
সুমনের বাবা ছোট কাজ করেন। তারা তিন ভাই, পরিবারে মোট পাঁচজন। বাবার পক্ষে পরিবার চালানো সম্ভব না বলেই সুমন বেকারিতে কাজ নিয়েছিলেন।
'বাবার সংসার চালাতেই হিমশিম, আমার চিকিৎসা তো দূরের কথা। আমি কর্ম হারিয়েছি, শরীরের যে অবস্থা আর কোনোদিন কাজ করতে পারব কিনা তাও জানি না।'
'মনে হচ্ছে, আন্দোলনে গিয়ে এখন আমি নিজেই পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি,' বলেন এ ভুক্তভোগী।
সুমনের বাবা আলী হোসেন বলেন, 'সুমনের আন্দোলনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আমি জানতাম না। কিন্তু ৫ তারিখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ফোন পেয়ে আমার দুনিয়া এলোমেলো হয়ে পড়ে।'
ছেলের চিকিৎসার খরচ বহন করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
'স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে, কিন্তু যারা পতনের জন্য জীবন উৎসর্গ করে আন্দোলন করেছে, তাদের দিকে এখন কেউ তাকাচ্ছেন না,' অভিযোগ করেন আলী হোসেন।
'আমার ছেলেটার জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে ভাসছে,' স্বৈরাচার পতনের জন্য আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ বা আহত হওয়াদের চিকিৎসা ও পরিবারের দায়িত্ব নিতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন তিনি।
ছেলের যন্ত্রণার আর্তনাদ সইতে পারেন না সুমনের মা ফরিদা খাতুন। 'তার কান্নার আওয়াজে আমার বুক ভারি হয়ে ওঠে। আমি মা হিসেবে সন্তানের কান্না শুনেও ডাক্তারের কাছে নিতে পারছি না — এর থেকে অসহায়ত্ব আর কী হতে পারে?'
কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার জানান, সুমনের মতো অনেক আহতের চিকিৎসা সহযোগিতা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
'কিন্তু সুমনের ব্যাপারটি এখনও আমাদের নজরে আসেনি। সুমনের পরিবার থেকে যোগাযোগ করা হলে অবশ্যই তার চিকিৎসা ও পরিবারের পাশে দাঁড়াবে জেলা প্রশাসন,' বলেন তিনি।