আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: বন্দরে আসার ৯ মাসেও নতুন কন্টেইনার স্ক্যানার বসাতে পারেনি কাস্টমস
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি কন্টেইনার স্ক্যানিংয়ের জন্য চীন থেকে ৪টি নতুন স্ক্যানার এসেছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। স্থান নির্বাচন নিয়ে জটিলতা, পুরোনো স্ক্যানার সরানো, বাজেট স্বল্পতাসহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের গেইটে বসানো যায়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আনা এসব স্ক্যানার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে স্ক্যানার ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়ার তিন বছর পর সেগুলো দেশে আসে। চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পরও নয় মাসের মধ্যে স্ক্যানারগুলো বসানো যায়নি। মাসের পর মাস পড়ে থাকার কারণে এগুলোর গুণগত মান নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা করছেন তারা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জানিয়েছে— এলসি সংক্রান্ত জটিলতা, ডলার সংকট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পরিবতর্ন-সহ নানামুখী জটিলতায় স্ক্যানার বসানোর কাজ বিলম্বিত হয়। এসব জটিলতায় কাটিয়ে এখন আবার স্ক্যনার বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এরমধ্যে এনসিটি ২ গেইটে স্ক্যানার বসানোর অবকাঠামোগত কাজ শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরের শেষ দিকে সবগুলো স্ক্যানার বসানোর দৃশ্যমান অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের মুখপাত্র সাইদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্ক্যানারের জন্য জায়গা নির্বাচন নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল, এখন সেগুলোর সমাধান করা হয়েছে। আশা করি, ডিসেম্বরের মধ্যে ইনস্টলেশন প্রক্রিয়া শেষ হবে।"
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দররের তিনটি টার্মিনাল— জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)— রয়েছে। এসব টার্মিনালে প্রবেশের জন্য মোট গেইট রয়েছে ১২টি।
কাস্টমসের সবশেষ আনা ৪টি স্ক্যানার বাসানো হবে এনসিটি–২, সিসিটি–২, জিসিবি–৪ এবং জিসিবি–৫ গেইটে। এরমধ্যে সিসিটি–২, জিসিবি–৪ এবং জিসিবি–৫ গেইটে কাস্টমসের পুরোনো চারটি স্ক্যানার ইতোমধ্যে রয়েছে। দীর্ঘদিনের পুরোনো হওয়ায় এই স্ক্যানারগুলো সরিয়ে সেখানে নতুন করে স্ক্যানার বসানো হবে। এরমধ্যে এনসিটি–২ গেইটে স্ক্যনার বসানোর জন্য অবকাঠামো তৈরির কাজ চলছে।
এদিকে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমদানি করা একই চীনা কোম্পানির আরও দুটি স্ক্যানার মেশিন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইনস্টল করা হয়েছে। ৮৫.৮৯ কোটি টাকায় কেনা স্ক্যানার দুটি জিসিবি–৪ গেইটে স্থাপন করা হয়। ফলে বন্দরের ১২টি গেইটের ৭টিতে স্ক্যানার সংখ্যা এখন ৯টিতে পৌঁছেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের স্ক্যানার স্বল্পতর সুযোগ নিয়ে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে একটি চক্র। তৈরি পোশাক, খাদ্য সামগ্রী, অ্যাগ্রো ফুডসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে তারা। হাজার কোটি টাকা পাচার-সহ পণ্য রপ্তানিতে কোটি কোটি টাকা ক্যাশ ইনসেনটিভ আত্মসাৎ করছে। এছাড়া, আমদানি পণ্য চালানের আড়ালে মদ, সিগারেট, আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য, ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানি করছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, "অনচেসিস ডেলিভারি, ডিপোগামী আমদানি কন্টেইনার স্ক্যানিংয়ে করা জরুরি। সব গেইটে স্ক্যানার না থাকার কারণে সবগুলো কন্টেইনার স্ক্যানিংয়ের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এটি আমাদের দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়িত। দ্রুত স্ক্যানারগুলো স্থাপন করে অপরেশনের আওতায় আনা জরুরি।"
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জন্য ৪টি-সহ মোট এই ছয়টি কন্টেইনার স্ক্যানার কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২১ সালে। সে বছর মার্চে প্রথমবার টেন্ডার আহ্বান করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। করোনাসহ বিভিন্ন জটিলতায় চার বার পিছিয়েছিল টেন্ডরের তারিখ।
সবশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি এনবিআরে স্ক্যানার কেনার বিষয়ে চুক্তি হয়। চীনের নিউটেক কোম্পানি লিমিটেডের তৈরি করা স্ক্যনার ৪টি সরবরাহের কাজ পায় ফাইভ-আর-অ্যাসোসিয়েটস। ছয়টি স্ক্যানার বসানোর জন্য এই প্রকল্পে ব্যয় নির্ধারণ হয় ১৪৭ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
স্ক্যানার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফাইভ-আর-অ্যাসোসিয়েটসের চট্টগ্রাম অফিসের ম্যানেজার আপেল বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, "চারটি স্ক্যানার মেশিনের মধ্যে একটি বাসানোর প্রক্রিয়া চলছে। বাকি তিনটির রিপ্লেসমেন্ট ধীরে ধীরে হবে। এগুলো রিপ্লেসমেন্ট করতে সময় লাগবে।"
তিনি বলেন, "এনসিটি–২ তে স্ক্যানার বসানোর কাজ শুরু হয় আগস্ট মাসে। এটির কাজ শেষ হবে অক্টোবরে। মেশিন বাসানোর শুরু হবে এরপর। একটি স্ক্যানার বসাতে সময় লাগে তিন মাস। যেসব স্ক্যানার রিপ্লেসমেন্টট হবে সেগুলো ডিজাইন, ড্রইং, সয়েল টেস্ট এর কাজ চলছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ সবগুলো স্ক্যানার বসানোর কাজ শেষ করা যাবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।"
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক (নিরাপত্তা)/অপারেশন মেজর মো. ওয়াহিদুল হক টিবিএসকে বলেন, "যেসব গেইটে স্ক্যানার রিপ্লেসেমেন্ট হবে, সেগুলো সরানো নিয়ে কাস্টমসের দিক থেকে কিছু সিন্ধান্তহীনতা, জটিলতা ছিল। সে কারণে স্ক্যানার বসাতে বিলম্ব হচ্ছে।"
এর আগে, ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ চীন থেকে আমদানিকৃত এফএস ৬০০০ সিরিজের অত্যাধুনিক দুটি ফিক্সড কনটেইনার স্ক্যানার বসায় বন্দরের এনসিটি–৩ এবং জিসিবি–১ নম্বর গেইটে।