নাহিদ ইসলাম যেভাবে ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র হয়ে উঠলেন
দুই বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাহিদ ইসলাম তার স্নাতক শেষ করেন। তার স্নাতকের থিসিসের বিষয় ছিল, 'কেন কোনো ছাত্র আন্দোলন কখনো তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি?' তার এ থিসিসের উপসংহার কী ছিল ২৬ বছর বয়সী নাহিদ তা মনে করতে না পারলেও তিনি কিন্তু ইতিহাস বদলে দিয়েছেন।
সম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখ হলেন নাহিদ ইসলাম। কিছুদিন আগেও তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে লুকিয়ে থাকতেন। আর বাচ্চাদের গৃহশিক্ষক হিসেবে আইসিটি বিষয়ে পড়াতেন। সেই তিনিই এখন বাংলাদেশের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
সেপ্টেম্বরের এক রবিবারেই নাহিদের সঙ্গে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক টাইম ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক। কালো চামড়ার তৈরি এক আরামদায়ক চেয়ারে বসেই সেদিন সাংবাদিককে তিনি বলেন, "শেখ হাসিনা একজন রক্তচোষা সাইকোপ্যাথ।"
জুন মাসে হাইকোর্ট যখন সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটা পুনর্বহালের রায় জানায় তখন কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে প্রবেশ করেন নাহিদ ইসলাম এবং প্ল্যাকার্ড হাতে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। নাহিদসহ অন্যান্যদের সবার দাবি ছিল সমান সুযোগের।
২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন সর্বপ্রথম বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শুরু হয়। সেসময় সরকার আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেয় এবং আন্দোলন থেমে যায়। এ বছরও কোটা ইস্যুতে আন্দোলন শেষ হয়ে যেতে পারতো বলে জানান নাহিদ। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করলে আন্দোলন গতি পায়।
১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ নামে এক আন্দোলনকারী। নাহিদ ইসলাম বলেন, "এ ঘটনা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দ্রুতই এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতিগ্রস্ত এ সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্রোধ সারাদেশের জনগণকে এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে।"
শেখ হাসিনার আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যখন নির্বিচারে ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালাতে থাকে আন্দোলন তখন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ৩ আগস্ট এ নাহিদ ইসলামই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে এক দফা দাবি: 'শেখ হাসিনার পতন'র ঘোষণা দেন। আর 'লং মার্চ টু ঢাকা' ঘোষণা একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করেন নাহিদ ইসলাম। আর সেদিনই পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ছেড়ে হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান হাসিনা। শেখ হাসিনা এখন সেই ভারতেই নির্বাসিত আছেন।
সেই বড় আরামদায়ক চেয়ারে বসে দুলতে দুলতেই নাহিদ বলেন,"কেউ ভাবেনি তাকে সরানো যাবে।"
হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দেশের ১৭ কোটি মানুষের দায়িত্ব নেয় শিক্ষার্থী আন্দোলনকারীরা। তাদের অনুরোধে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ৮৪ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে উন্নয়নশীল শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে তিনি বিভিন্ন আইনি অভিযোগে জর্জরিত নির্বাসিত জীবন পার করছিলেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর সব অভিযোগ থেকে খালাস পান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে এখন ইউনূসই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কিন্তু শুধু ছাত্ররা চেয়েছিল বলেই তিনি এ আসনে এসেছেন। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে নাহিদ ইসলাম একটু হাসেন। তিনি বলেন, "ড. ইউনূস সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।"
তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ডেস্কে রাখা লাল ল্যান্ড ফোনের দিকে ইশারা করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নাহিদ বলেন, "এটি ভিআইপি ফোন। আমি কীসের জন্য এটি ব্যবহার করবো, কোনো ধারণা নেই। আমি ইউনূসকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করি।"
নাহিদ এখনো তার জীবনের গত কয়েক সপ্তাহে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। যদিও তার স্থির মনোভাব দেখে তা বোঝা দায়।
নাহিদ ইসলামের ব্যক্তিগত সচিব তারচেয়ে বয়সে বড় এবং দেখে বেশ চাপগ্রস্তই মনে হয়। বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে বারবার নাহিদের কক্ষে আসছেন এবং বেরিয়ে যাচ্ছেন। নাহিদের দুটি মোবাইল ফোন নিয়মিতই বেজে চলেছে এবং তার সঙ্গে রাতের শেষ প্রহরেও অনেকে দেখা করতে আসছেন সবুজে ঘেরা বাসভবনটিতে। আর যে কক্ষে নাহিদ বসেন তা তার পুরোনো অ্যাপার্টমেন্টের সমান বড়।
সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করা নাহিদ ইসলাম সবসময়ই হাসিনা সরকার বিরোধীদের দলেই ছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের প্রথম সপ্তাহেই সুন্দরবনের কাছে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যোগ দেন নাহিদ। ২০১৯ সালে নাহিদ ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পরে সহপাঠীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন।
কিন্তু প্রথমবারের মতো জনগণের নজরে আসেন এ বছরের জুলাইয়ে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে অপহরণ করে এবং নির্যাতন চালায়। এক রাতে প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা সাদা পোশাকে নাহিদের এক বন্ধুর বাড়িতে উপস্থিত হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে নাহিদ বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি। নাহিদ এ বিষয়ে বলেন, "গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা যখন তার মাথায় কালো কাপড় বাঁধছিল তখন তাকে বলেছিল, তোমাকে আর কেউই কোনোদিন দেখতে পাবে না।"
নাহিদ ইসলাম দাবি করেন, সেসময় তাকে একটি গোপন কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাকে লোহার রডের মতো কিছু দিয়ে মেরেছিল। যার কারণে তার হাতেপায়ে আঘাতের চিহ্ন পড়ে গিয়েছিল। মারধর, ব্যথা, মাথার উপর জ্বলে থাকা আলো সবকিছুর প্রভাবে নাহিদ বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন।
নাহিদ ইসলাম সেসব দিনের কথা মনে করে বলেন, "তার কাছে তারা জানতে চাচ্ছিল, মাস্টারমাইন্ড কে? অর্থ কোথা থেকে আসছে?" পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে একদিন তাকে একটি ব্রিজের পাশে ফেলে দেওয়া হয়। স্থানীয় গণমাধ্যমে তার আঘাতের ছবি প্রকাশ করলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
গোয়েন্দা সংস্থা একজন মুখ খুঁজছিল। এ বিষয়ে নাহিদ বলেন, "আসলে আমাদের নেতা একজন ছিল না। এটাই আমাদের আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল।" এখন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন নাহিদ। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন, আন্দোলনে নেতৃত্ব দলগত কাজ ছিল। তিনি বলেন, "গণমাধ্যম সবসময় একজন মুখ চায়। কিন্তু আমি এই আন্দোলনের একমাত্র নেতা নই। আমাদের অনেকেই ছিল।"
হাসিনা সরকার উৎখাতের পর ক্ষমতার শূন্যতা দ্রুত পূরণ করা জরুরি ছিল। নাহিদ ইসলাম সম্পর্কে তার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, "ছাত্ররা যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা দেয় সেদিন আমি অস্বাভাবিকভাবে একজন নার্ভাস নাহিদকে দেখেছিলাম। সে খুবই ছোট, কিন্তু তার জন্য এটি খুবই বড় একটি দায়িত্ব।"
এই পরিবর্তনের পরপরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। নতুন এই বাংলাদেশে সবাই তাদের থেকে সেরাটাই আশা করছে। কারণ তারা সাধারণ জনগণকে 'এক স্বৈরাচারীর' হাত থেকে মুক্ত করেছে।
এসব আলাপচারিতার মধ্যেই আবার বেজে ওঠে নাহিদ ইসলামের ফোন। একটি হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। সেখান থেকে অভিযোগ এসেছে, সেখানে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠলে ছাত্ররা ডাক্তারদের ওপর হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে ডাক্তাররা ধর্মঘট ডেকেছে। যখন তাড়াতাড়ি মুরগি দিয়ে ভাত খেয়ে নিচ্ছিলেন এর মধ্যেই নাহিদের আরেকটি ফোন আসে। সেসময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আন্দোলনে অংশ নেওয়া কিছু ব্যক্তি সরকারি চাকরির দাবিতে ইউনূসের কার্যালয়ের ফোন নম্বর পাওয়া যাবে কিনা বলে জিজ্ঞেস করছে।
"বিষয়টা অদ্ভুত, একসময় আমরা এই অবস্থানে ছিলাম" বলে মন্তব্য করেন নাহিদ। তিনি এ আন্দোলনকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, "এখন আমাদেরই এসব বিষয় দেখতে হবে।"
প্রায় ১৫ বছর ধরে মানুষের কণ্ঠস্বর রোধ করা ছিল। এসময় ভোটে কারচুপি হয়েছে, সমালোচকদের ওপর দমন-পীড়ন হয়েছে এবং মানুষ ভয়ের মধ্যে বসবাস করতো। এখন মানুষ তাদের নতুন স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করছে। নারীরা হয়রানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে আন্দোলন করছে। উচ্চবিত্ত এলাকার স্কুলের শিক্ষার্থীরাও তাদের অপছন্দের প্রিন্সিপালকে সরিয়ে দিতে বিক্ষোভ করছে। এ বিষয়কে ব্যাখ্যা করে নাহিদ বলেন, "গত ১৫ বছর ধরে মানুষ কথা বলতে পারেনি, এখন তারা অবশেষে সুযোগ পাচ্ছে।"
কিন্তু তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ত এখনও সামনে রয়েছে।
দেশে একটি সাধারণ স্বস্তির অনুভূতি থাকলেও উদ্যাপনের জন্য খুব বেশি সময় পাওয়া যায়নি। নতুন সরকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। এছাড়াও আরেকটি ভয় রয়েছে যে সেনাবাহিনী বা উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগ আবার জোর করে ক্ষমতা ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। আর বাংলাদেশে এ ঘটনা প্রথম নয়। এ দেশের রাজনীতি সহিংসতার জন্য বহুবার কলঙ্কিত হয়েছে।
এ বিষয়ে নাহিদ বলেন, "অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হলো দুর্নীতি নির্মূল করা এবং দেশকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা। আমরা এখানে অল্প সময়ের জন্যই থাকব।"
তিনি আরও বলেন, "দুর্নীতি ও সহিংসতা- মানুষ এগুলো আর চায় না। আমাদের নতুন প্রজন্মের মনোভাব বোঝা উচিত। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।"
অনুবাদ: সাদিয়া আফরিন রেনেসাঁ