বন্ধ হয়েছে বাবার চায়ের দোকান, লেখাপড়া-চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তায় গুলিবিদ্ধ তাইবুর
পাঁচ বছর আগে নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বাড়ি। অন্যের জমিতে ছোট্ট একটা ঘর তুলে তাতে চায়ের দোকান চালান মাইনুল খান। বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুধল ইউনিয়নের মাইনুল খানের পরিবার অনেক কষ্টেই দিন কাটান। তারপরও ছেলে তাইবুর রহমানের পড়ালেখায় বাধা দেননি তিনি। ছেলে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করায় ভর্তি করান বরিশাল শহরের ইসলামিয়া কলেজে। কিন্তু ৪ আগস্ট সবকিছু ওলটপালট করে দেয় মাইনুল খানের।
মাইনুল খানের ছেলে তাইবুর রহমান সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, "আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা। হঠাৎ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠলো দেশ। প্রথম অবস্থায় কি করবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। পরে যখন দেখলাম আশেপাশের অনেক সহপাঠী আহত হচ্ছে এবং ঢাকায় অনেকে মারা গেছেন। এসব শুনে আমিও ঘরে থাকতে পারিনি। তাই আন্দোলনে যোগ দেই।"
তাইবুর আরও বলেন, "৪ আগস্ট তৎকালীন সরকার দলের লোকজন আমাদের রাস্তায় প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল। আমরা মিছিল নিয়ে হাতেম আলী কলেজের চৌমাথা হয়ে বটতলার দিকে যাই। ফরেস্টার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা গুলিতে আমি লুটিয়ে পড়ি।"
তাইবুরের চিকিৎসা চলছে। তার বাবার টাকা দিয়েই এতোদিন চিকিৎসা চলেছে তাইবুরের। তার বাবা মাইনুল খান তার চায়ের দোকানের সবটুকু পুঁজি দিয়ে ছেলের চিকিৎসা করান। সেই টাকা দিয়ে তাইবুরের মাথা থেকে গুলির দুটি কণা বের করেছে লেবুখালি সেনানিবাসের হাসপাতাল। এখনো পাঁচটি বুলেটের কণা মাথায় রয়ে গেছে। এছাড়া পিঠে আরও সাত থেকে আটটি গুলির কণা রয়েছে। তাইবুর এ বিষয়ে বলেন, "আমার চিকিৎসা বন্ধ, লেখাপড়া বন্ধ। বর্তমানে ফুফুর বাসায় আছি।"
তিনি আরও বলেন, "শুনেছি অনেকে সরকারি সহায়তায় চিকিৎসা করাচ্ছেন অথচ আমার কেউ খোঁজ নেয়নি। বাবার যতটুকু সামর্থ্য ছিল তা দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।"
কেউ খোঁজ না নেওয়ায় খারাপ লাগে জানিয়ে তিনি বলেন, "ওসব কিছু মনে রাখি না, কারণ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম দেশের কল্যাণের জন্য। আমার খোঁজ কেউ নিবে এই প্রত্যাশা করি না। বিপ্লবী ছাত্র-জনতার সঙ্গে সবসময় ছিলাম, আছি, প্রয়োজনে সামনেও থাকবো।
তিনি আরও বলেন, "শুনছি অনেকে সহায়তা পেয়েছে, আমি এসব প্রত্যাশা করি না আর করবও না। শুধু এটুকু চাই, আন্দোলনে সবার সাথে ছিলাম, দেশের জন্য আমারও ভূমিকা আছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছি, এটা একটু জানুক।"
বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুধল ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের দুধল আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ ৪ পেয়ে পাস করেন তাইবুর। গ্রামের বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় তার মা তাসলিমা বেগম বরিশালে ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন।
তাসলিমা বলেন, "তাইবুর এখনো সুস্থ হয়নি। অসুস্থ শরীর নিয়ে ঢাকায় আছে। বরিশালেতো চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা করতে পারিনি। কেউ একদিনের জন্য খোঁজও নেয়নি তাইবুরের।"
তিনি আরও বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবেদন আমার ছেলের যেন লেখাপড়া বন্ধ না হয়ে যায় ওর চিকিৎসার যেন ব্যবস্থা করা হয়। দোকানের টাকা সব চিকিৎসায় খরচ করে আমাদের অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটছে।"
তাইবুরের বাবা মাইনুল খান বলেন, "আন্দোলনে আমার ছেলের পুরো শরীরে গুলি লেগেছে। ৪ আগস্টের পর সরকার বা অন্য কেউ একবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি আমাদের। কীভাবে চিকিৎসা চলছে, ওর লেখাপড়া আদৌ হবে কিনা তা অনিশ্চিত। ওদিকে আমার দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পালা।"
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাবুব উল্লাহ মজুমদার বলেন, "আন্দোলনে শহীদদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। আহতদের সহায়তার জন্য সরকার থেকে কোন বরাদ্দ বা নির্দেশনা আসেনি। তবে আহতদের চিকিৎসা না চললে আবেদন করার জন্য বলবো। সমাজসেবা বা অন্য যেকোনো ফান্ড দিয়ে দ্রুততার সাথে সহায়তা করা হবে।"