‘শাহের’ উল্টো করে ঝুলানোর হুমকি নতুন নয়
মানুষকে 'উল্টো করে ঝোলানো' ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বহুদিনের অভিপ্রায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উল্লেখ করে এই ইচ্ছা আবারও প্রকাশ করেন তিনি– যা নিয়ে তার দেশের সাথে বাংলাদেশের এক কূটনৈতিক টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে দেশটির শীর্ষ একজন রাজনীতিবিদের এ ধরনের মন্তব্য অত্যন্ত অবমাননাকর।"
তিনি সতর্ক করে বলেন, এতে দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক বিকশিত তো হবেই না, বরং আরো অবনতি হবে– বিশেষত ওই দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে যদি এমন মন্তব্য করা হয়।
গত ৫ গণঅভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপরে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে ইতোমধ্যেই চিড় ধরেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে ভারতের 'অ্যাসেট' বা স্বার্থ হাসিলের এজেন্ট ছিলেন শেখ হাসিনা, ফলে তার পতন নয়াদিল্লির জন্য গুরুতর এক আঘাত হয়ে এসেছে। যেকারণে তাঁদের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এধরনের নির্বোধের মতো মন্তব্য করছেন।
তারা বলেছেন, এর আগেও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে এমন মন্তব্য করেছেন অমিত শাহ, এখন বাংলাদেশ নিয়েও করছেন।
প্রসঙ্গত, গেল সপ্তাহে ঝাড়খন্ডে এক নির্বাচনী প্রচারণায় অমিত শাহ বলেন, রাজ্যটির বাসিন্দারা যদি ভোট দিয়ে বিজেপিকে নির্বাচিত করে তাহলে "প্রতিটি অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করবে" বিজেপি। এ সংবাদ পরে প্রকাশ করে বার্তাসংস্থা এএনআই।
অমিত শাহ বলেন, "অনুপ্রবেশকারীরা লালু যাদব, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) এবং কংগ্রেস পার্টির ভোট ব্যাংক। আপনারা যদি ঝাড়খন্ডের সরকার পরিবর্তন করেন– তাহলে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ঝাড়খন্ড থেকে একজন একজন করে সব অনুপ্রবেশকারীকে বের করে দেবে বিজেপি।"
তবে মানুষকে এই 'উল্টো করে ঝোলানোর' খায়েশ নিয়ে অমিত শাহের মন্তব্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথারই প্রতিধ্বনি।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজ্যটির অন্যতম শিল্পশহর জমশেদপুরে এক জনসভায় মোদি বলেন, সাঁওতাল পরগণা আর কোলহান অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমান ও বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ ঝাড়খন্ডের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা।
নরেন্দ্র মোদি এ সময় অভিযোগ করেন, 'বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়েছে জেএমএম। অনুপ্রবেশকারী ও চরমপন্থীরা জেএমএম দখল করে নিচ্ছে। এটা ঘটছে; কারণ, জেএমএমের ওপর কংগ্রেসভূত ভর করেছে। কংগ্রেসের ভূত যখন কোনো দলের ওপর ভর করে, তখন সেই দলের অ্যাজেন্ডাই হয় তোষণ। এসব দল নিজেদের পক্ষে ভোট টানার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে।'
অমিত শাহ পরবর্তীতে তার দলের সর্বোচ্চ নেতার কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন, তবে তিনি 'প্রতিটি বাংলাদেশিকে অনুপ্রবেশকারীকে উল্টো করে ঝোলানোর' হুমকিও দেন।
বাংলাদেশিদের নিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর এ মন্তব্যে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
অমিত শাহর মন্তব্যে অসন্তোষ জানিয়ে গতকাল সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ঢাকায় ভারতের উপহাইকমিশনার পবন ভাদের কাছে এ প্রতিবাদপত্র দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবাদপত্রে বাংলাদেশ লিখেছে, প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল পদে থাকা কোনো ব্যক্তির এ ধরনের মন্তব্য বন্ধুত্বপূর্ণ দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ন করে।
ভারত সরকারকে সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ ধরনের আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করা থেকে বিরত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে অমিত শাহের 'উল্টো করে ঝোলানোর' মন্তব্য নতুন নয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক খবর অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে এক জনসভায় তিনি বলেন, "সন্দেশখালির দোষীদের সব ক'টাকে উল্টো ঝুলিয়ে সিধে করে দেওয়া হবে" এবং জেলে ভরা হবে।
তিনি বলেন, "লোকসভা নির্বাচনের পরে বিজেপি এখানে (পশ্চিমবঙ্গে) সরকার গঠন করবে। তখন আমরা মমতা দিদির গুণ্ডাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে দেব।"
লোকসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে করা জনসভায় তার বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে এনডিটিভি জানায়, অমিত শাহ বলেছিলেন, "মা, মাটি ও মানুষের স্লোগানকে সামনে রেখে ক্ষমতায় আসেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু, সন্দেশখালিতে মায়ের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। মাটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশি অনুপ্রদেশকারীদের আর দুর্নীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। আপনারা বিজেপিকে ভোট দিন, তাহলে মমতার গুণ্ডাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করা হবে।"
এবারই প্রথম বাংলাদেশিদের 'অনুপ্রবেশকারী' বলেননি অমিত, এর আগে তিনি বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করে 'উইপোকা' বলে মন্তব্য করেছিলেন।
আজ থেকে ঠিক ছয় বছর আগে– ২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন বা এনআরসি প্রসঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেন, "অনুপ্রবেশকারীরা ভারতে ঢুকে পড়েছে। তারা উইপোকার মতো দেশকে খেয়ে ফেলছে।"
তার দাবি ছিল, ভারতের ভোটার তালিকায় বাংলাদেশিরা ঢুকে পড়ছেন। তাই খুঁজে খুঁজে ভোটার তালিকা উইপোকামুক্ত করবেন তারা। এনআরসি প্রসঙ্গে বলেন, আসামে ইতিমধ্যে এরকম ৪০ লাখ 'উইপোকা' চিহ্নিত করা হয়েছে।