আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ধারা সংশোধন: রাজনৈতিক সংগঠন ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধের প্রস্তাব
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ধারা সংশোধনের জন্য ৮টি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনীতে।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক মতবিনিময় সভায় এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় 'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩' সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনী উপস্থাপন করা হয়।
খসড়া সংশোধনীতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধ করলে কোনো রাজনৈতিক দলকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার মতো বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া সংশোধনীতে।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, "গত জুলাই হত্যাকাণ্ডে জনগণ নিজ চোখে দেখেছেন একটি বৃদ্ধ প্রজন্ম দেশের একটি তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় মেতেছিল। আমাদের বুকের ভিতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্ষোভ থাক, এই খুনের বিচারকে অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার বিচার করতে চাই না। আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই।"
অতীতে এদেশে বিচারের নামে অবিচার হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, "আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো।"
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে সচল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানান ড. আসিফ নজরুল বলেন।
তিনি বলেন, "এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বোর্ড (ট্রাইব্যুনাল)-কে পুনর্গঠন করা। আমরা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, '১৯৭৩' সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি।"
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সবার মতামত নিয়ে এই আইন সংশোধন করা হবে বলে জানান আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা।
৮ খসড়া সংশোধনী প্রস্তাব
প্রথম সংশোধনী ধারা ৩
এ সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় একটি ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণের অংশ হিসেবে গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক যৌনকর্ম, জোরপূর্বক গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর কারণে জেন্ডার ও কালচার গ্রাউন্ডেও যদি কোনো সিভিলিয়ানের ওপর ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণ করা হয় তাহলে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যা আগের আইনে ছিল না।
দ্বিতীয় সংশোধনী ধারা-৩(৩)
এ সংশোধনীর ফলে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় বা লায়াবিলিটি নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটের ধারা-৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এর 'এলিমেনটস অব ক্রাইম' (অপরাধের উপাদান) বিবেচনা করার সুযোগ পাবে।
তৃতীয় সংশোধনী ধারা-৪(২)
এ সংশোধনীর ফলে, এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র বা সত্তার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে তাকেও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে, যা বর্তমান আইন অনুযায়ী সম্ভব না।
চতুর্থ সংশোধনী
এই সংশোধনীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে ভিডিও স্ট্রিমিং বা অডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিংয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ সংশোধনীর বুনিয়াদে বিচার কার্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।
পঞ্চম সংশোধনী
এ সংশোধনীর প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে অভিযুক্ত চাইলে তার পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবে।
ষষ্ঠ সংশোধনী
বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা ত্বরান্বিত করবে। এ সংশোধনীর অধীনে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
সপ্তম সংশোধনী
এর মাধ্যমে প্রায় সব রকম ডিজিটাল সাক্ষ্যকে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অষ্টম সংশোধনী
প্রস্তাবিত এ সংশোধনীর মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে।
আইনটির প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ, শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব (চলতি দায়িত্ব) ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও অধ্যাপক নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া নিজস্ব মতামত তুলে ধরেন।
এছাড়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বেগম আসমা সিদ্দিকা, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের যুগ্মসচিব (ড্রাফটিং) মো. রফিকুল হাসান, ঢাকাস্থ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী অফিসের কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ড. জাহেদুর রহমান, সাংবাদিক সাঈদ আব্দুল্লাহ, সানজিদা ইসলাম, শরিফ ভূঁইয়া প্রমুখ তাদের মতামত তুলে ধরেন।