আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল: পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পর এবার ২৫,০০০ টাকা মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকার আশুলিয়ায় বিভিন্ন দাবিতে টানা দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় যাবত শ্রমিক অসন্তোষ চলার পর, সম্প্রতি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও আবারও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেছেন পোশাক খাতের শ্রমিকরা।
আজ রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের জিরাবো এলাকা পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে অবস্থিত বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় কাজ বন্ধ রেখে এই বিক্ষোভ শুরু করেন।
এ সময় বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কারখানার অভ্যন্তরে জড়ো হয়ে পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে 'পঁচিশ' 'পঁচিশ' স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
শিল্প সূত্র জানায়, সকাল থেকে আশুলিয়া বেল্টে নীট এশিয়া, ডেকো, এনভয়, ভিনটেজ, নাসা, সেতারাসহ বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের কারখানা ছুটি ঘোষণা করে।
শিল্প পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শ্রমিক অসন্তোষ শেষে গত সপ্তাহ এবং চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন, অর্থাৎ গতকাল পর্যন্ত শিল্পাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও আজ সকাল থেকে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে এই বিক্ষোভ শুরু করেন।
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডেকো গ্রুপের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এর আগে শ্রমিকদের যেসব দাবি ছিল, সেগুলো আমরা প্রথম দফাতেই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন শ্রমিকরা নতুন দাবি নিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ করছেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তারা সিদ্ধান্ত চান।"
তিনি বলেন, "সকালে শ্রমিকরা কারখানাটিতে ঢুকে, ফ্লোরে উঠেই নেমে যান। এরপর থেকে গ্রাউন্ডে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।"
"অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে বের হয়ে গেলেও আমাদের শ্রমিকরা এখনো যাননি। বেশ কয়েকজন স্টাফ-কর্মকর্তাকে তারা অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। তাদের একটি অংশ দাবি করছেন, এখনই তাদের ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবি মেনে নিতে হবে। আবার কেউ বলছেন, টিফিনের টাকা বাড়িয়ে যেটি ৪০ টাকা করা হয়েছে, সেটি এবার ৫০ টাকা করতে হবে। কেউ আবার হাজিরা বোনাস আরও বৃদ্ধি করতে বলছেন, যেটি ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে ইতোমধ্যেই," যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
পুলিশ জানায়, কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা আজ সকালে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলেও পুলিশ ও যৌথ বাহিনী তাদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেয়।
সূত্র জানায়, বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ডেকোসহ বেশ কয়েকটি কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছিলেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সচেষ্ট রয়েছে বলেও জানায় সূত্রটি।
তবে বেলা সাড়ে ১২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোথাও কোনো সড়ক অবরোধের তথ্য পাওয়া যায়নি।
যোগাযোগ করা হলে শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গতকাল নাসায় সামান্য ঝামেলা হওয়ার পর নাসা বন্ধ ছিল। আজকে কিছু কারখানার শ্রমিকরা কোথা থেকে কী তথ্য পেয়ে এটি করছে। মূলত ২৫ হাজার টাকা বিষয় না; এছাড়াও যেমন মেডলারের শ্রমিকদের দাবি হচ্ছে মালিক আসে না, কথা বলে না শ্রমিকদের সাথে, তাদের দাবি মেনে নেওয়া হলেও মালিকও নিজে গিয়ে তাদের আশ্বস্ত করুক- এটা চায় তারা। ভিনটেজের শ্রমিকদের দাবি, তাদের কারখানা খুলে দেওয়া হোক। রোজই কিছু দাবি মেনে নেওয়ার পর, এখন আবার নতুন দাবি করছে।"
তিনি আরও জানান, শিল্পাঞ্চলে আজ বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩(১) ধারায় ১৫টি এবং ৪টি কারখানায় সাধারণ ছুটি চলছে।
এদিকে বিজিএমইএ বলছে, আজ আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে মোট ২৭টি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
এরমধ্যে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩(১) ধারার (নো ওয়ার্ক, নো পে) ভিত্তিতে ১৩টি এবং কারখানা খোলা রাখার পর কাজ বন্ধ আছে কিংবা স্ববেতনে ছুটি আছে এমন কারখানার সংখ্যা ১৪টি।
শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে- কমফিট কম্পোজিট লিমিটেড, নাসা সুপার কমপ্লেক্স লিমিটেড, সেতারা গ্রুপ, শিন শিন অ্যাপারেলস লিমিটেড, জেনারেশন নেক্সট, ভিনটেজ গার্মেন্টস লিমিটেড, আঞ্জুমান ডিজাইনার্স লিমিটেড।
এছাড়া স্ব-বেতনে ছুটি রয়েছে, কাজ বন্ধ আছে কিংবা শ্রমিকর চলে গেছে এমন কারখানাগুলোর মধ্যে আছে- এএম ডিজাইন লিমিটেড, ডেকো গ্রুপ, ব্যান্ডো ডিজাইন লিমিটেড, এনভয় গ্রুপ, অনন্ত গ্রুপ, নিউএইজ গ্রুপ, স্টারলিং ক্রিয়েশন, স্টারলিং অ্যাপারেলস, ইয়াগি বাংলাদেশ, দ্য রোজ গার্মেন্টস, টেক ম্যাক্সসহ মোট ১৪টি কারখানা।
বিজিএমইএ আরও জানায়, আশুলিয়া অঞ্চলে আজ তাদের ২৪৫টি কারখানা চালু রয়েছে। এছাড়া, আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করেছে ২৬৬টি কারখানা এবং আগস্ট মাসের বেতন এখনো দিতে পারেনি ৬টি কারখানা।
বিজিএমইএর তথ্যমতে, আজ গাজীপুর এলাকায় তাদের চালু কারখানার সংখ্যা ৮৭৬টি, বিপরীতে বন্ধ রয়েছে ৬টি কারখানা। সাভার আশুলিয়া এবং জিরানি এলাকায় চালু রয়েছে ৪০৭টি এবং বন্ধ রয়েছে ২৭টি কারখানা।
এছাড়া, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ২০৯টি কারখানা, ডিএমপি এলাকায় ৩০২টি এবং চট্টগ্রামে ৩৫০টি কারখানা চালু রয়েছে। এসব এলাকায় কোনো কারখানা বন্ধ নেই।
'হাতেগোনা কয়েকটি কারখানায় ঘুরেফিরে সমস্যা হচ্ছে' - শ্রমিক নেতা
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হবে, রেশন ব্যবস্থা চালু করা দরকার, এসবের সাথে আমাদের দ্বিমত নেই। কিন্তু যেই প্রক্রিয়াতে এখন আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা আমরা তাকে সমর্থন করি না। আমার মনে হয় শ্রমিকদের কিছুটা ধৈর্য ধরা উচিত, কারন নতুন সরকার সবে মাত্র দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং ইতিমধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে সরকার কিন্তু ইতিবাচকভাবে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
যদিও এই আন্দোলনে শ্রমিকদের উপর শ্রমিক নেতাদের তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই দাবি করে এই শ্রমিক নেতা বলেন, "নতুন সরকার কিন্তু বলেছে যে শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে। এবং সরকার এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের পক্ষেই কথা বলছে যেমন টিসিবি কার্ড করার কথাও বলা হয়েছে। কাজেই কর্মবিরতি দিয়ে, এই পদ্ধতিতে আন্দোলন করাকে আমরা যৌক্তিক মনে করছি না।
এসময় এই আন্দোলনে একটি বিশেষ পক্ষের উষ্কানি থাকতে পারে উল্লেখ করে মিন্টু বলেন, আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন মাত্র ১/২ শতাংশ কারখানায় ঘুরেফিরে সমস্যা হচ্ছে। আমি কিছুদিন আগেও যৌথবাহিনীর সাথে এক সভায় বলেছিলাম এখানে যে হাতেগোনা কয়েকটি কারখানায় থেকে ঝামেলার সূত্রপাত হচ্ছে সেটি লক্ষ্যনীয় এবং আমার মনে হয় এটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। কারা এটি করছে এবং কেন করছে, সেটি যদি মালিকপক্ষ শনাক্ত করে তাদের সাথে আলোচনা করতে পারে আমার মনে হয় সমস্যা সমাধান সম্ভব। ছাটাই করে মামলা করে সমস্যার সমাধান হবে না।
গ্রীন বাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ইলিয়াস টিবিএস'কে বলেন, শ্রমিকরা এখন ২৫ হাজার টাকা নুন্যতম মজুরি দাবি করে যেই আন্দোলন করছে আমরা এটাকে সমর্থন করি না। কারন মজুরি বৃদ্ধির তো একটি প্রক্রিয়া আছে এবং সেটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। তাছাড়া এক বছরও পার হয়নি নতুন মজুরি গঠন হয়েছে। আমি মনে করি শ্রমিকদের এখন কিছুটা ধৈর্য ধারন করা উচিৎ, আমরাও বিশ্বাস করি বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির বাজারে এই মজুরি সমন্বয় করা উচিৎ। কিন্ত এর জন্য সরকারকে সময় দিতে হবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় দাবি জানানো যেতে পারে।