অগ্রাধিকার ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে বিদেশি ঋণের প্রকল্প পর্যালোচনা করবে সরকার
চলমান, প্রস্তাবিত বা আলোচনা পর্যায়ে থাকা বৈদেশিক ঋণের সব প্রকল্পই পর্যালোচনা করবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়াসহ গুরুত্ব বিবেচনায় প্রকল্পের অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এর অংশ হিসেবে, বৈদেশিক অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারি সংস্থাগুলোকে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে প্রকল্পের যৌক্তিকতা, উপযুক্ততা, কার্যক্রম, প্রস্ততিমূলক অগ্রগতির তথ্যসহ অগ্রাধিকার তালিকা চলতি মাসের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
ইআরডির প্রত্যেক উইং থেকে আলাদা আলাদা এই চিঠি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে পাঠানো হয়েছে। চীনের অর্থায়নে প্রস্তাবিত ও চলমান প্রকল্পের জন্য গত মাসের শেষের দিকে এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যংক বা বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের তথ্য চেয়ে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্পে গুরুত্ব নির্ধারণ, অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছাটাই এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত করতে এই অগ্রাধিকার তালিকা চাওয়া হয়েছে বলে ইআরডির কর্মকর্তারা জানান।
এই বিষয়ে ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী টিবিএসকে বলেন, "বৈদেশিক অর্থায়নের সব প্রকল্পই পর্যালোচনা প্রথম পর্যায়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তাব পুনরায় ইআরডি পর্যালোচনা করবে। এরপর উন্নয়ন সহযোগীদের এবং বাস্তবায়ন সংস্থার সঙ্গে ত্রি-পক্ষীয় সভা করে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা হবে।"
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত প্রকল্প এবং নেগোশিয়েশন (আলোচনা) পর্যায়ে থাকা প্রকল্পে কিংবা এখনও দরপত্র আহ্বান করা হয়নি— এমন প্রকল্পগুলো যাচাইয়ে বেশি সতর্ক থাকবে ইআরডি, যাতে আর কোনো অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়ন করতে না হয়।
কর্মকর্তারা আরো জানান, অগ্রাধিকার তালিকার বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগীরা আগ্রহ দেখিয়েছে। তাদের মতে, এতে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ বিতরণ সহজ হবে। পরিকল্পনা মাফিক উন্নয়ন কাজ তরান্বিত করা যাবে।
অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের উদাহরণ দিতে গিয়ে ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা–চট্টগ্রামছাড়াও দেশের অন্যান্য ৬ বিভাগে পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপনের একটি প্রকল্প বিগত সরকারের সময় নেওয়া হয়েছিল। চীনা ঋণের এই প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৭ সালের মার্চে। ওই সময় প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল ১,৩১৯ কোটি টাকা— যেখানে চীনের ঋণ ধরা হয়েছিল ৯৮৮.৫৫ কোটি টাকা।
বৈদেশিক ঋণে এ ধরনের অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী ছিল না ইআরডি। এ কারণে প্রায় আট বছরে ধরে এই প্রকল্পের ঋণ প্রক্রিয়া ঝুলে ছিল। যদিও চীন এই প্রকল্পে ঋণ দিকে ব্যাপক আগ্রহী ছিল। এছাড়া, সরকারের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীও এ বিষয়ে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন বলে ইআরডি কর্মকর্তারা জানান।
ইআরডি কর্মকর্তারা আরো জানান, বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি পূর্ণাঙ্গ টিভি সেন্টার আছে। সরকাকে এগুলো ভর্তুকি দিয়ে চলতে হয়। দেশের বাকি ৬ বিভাগে আরো ৬টি টিভি স্টেশন করা হলে ব্যাপক জনবলের প্রয়োজন হবে এবং পরিচালনায় সরকারের ভতুর্কি অনেক বেড়ে যাবে। এসব বিবেচনায় এই প্রকল্পে ইআরডির আগ্রহ ছিল না।
এই প্রকল্পটি এখনো চীনের অর্থায়নের প্রস্তাবিত তালিকায় রয়েছে। এই প্রকল্পসহ এ ধরনের অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এবার বাছাই করা হবে এবং বাদ দেওয়া হবে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।
ইআরডির কর্মকর্তারা আরো জানান, বিভিন্ন সময় ঢট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের লক্ষ্যে বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত করতে ইআরডির ওপর চাপ ছিল। কিন্ত ইআরডি এই প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ নিতে অনাগ্রহী ছিল। কারণ ৮,৯২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মিটারগেজ রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তরের প্রকল্পকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ইআরডি।
ফলে যেসব প্রকল্প থেকে দ্রুত রিটার্ন আসবে এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, সেসব প্রকল্প অগ্রাধিকার দিয়ে আগে বাস্তবায়ন করা উচিত বলে মনে করে ইআরডি। এ কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে তারা।
ইআরডির কর্তমকর্তারা আরো জানান, অনেক সময় প্রকল্পের সব প্রস্তুতি শেষ না করেই নেওয়া হয়। কিন্ত ঋণ চুক্তির পরে দেখা যায়, নানান জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় না। এতে উন্নয়ন সহযোগীদের কমিটমেন্ট ফি দিতে হয়। এক্ষেত্রে সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিবেচনায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে, এমন প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা রেল সংযোগসহ বৈদেশিক ঋণে সম্প্রতি সময়ে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বা হচ্ছে। আবার কোভিড ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সৃস্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাপক বাজেট সহায়তা নিয়েছে। এতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমগত বাড়ছে।
অর্থনীতিতে দ্রুত অবদান রাখবে, দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে— এমন প্রকল্প এখন অগ্রাধিকার পাওয়া দরকার বলে জানায় ইআরডি।
সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়ে হয়েছে ৬৯.৬৬ বিলিয়ন ডলার— যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে আউটস্ট্যান্ডিং বেড়েছে ১১.৬ শতাংশ।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী গত ৫ বছরে সরকার বাজেট সহায়তা হিসেবে ৮.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি নিয়েছে। বাজেট সহায়তা ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থ ছাড় হয়ে যায়। ফলে বাজেট সহায়তার কারণেও বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়েছে। এই অবস্থায় নতুন বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে বলে মনে করছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাজেট সহায়তা নিয়েছে, এর ৬০ শতাংশের বেশি নিয়েছে কোভিড ও ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায়। ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, বৈদেশিক ঋণের বকেয়া বাড়ার কারণে ঋণ পরিশোধেরও চাপ বাড়বে। গত অর্থবছরে সরকার ৩.৩৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে। এরমধ্যে আসল হিসাবেই পরিশোধ করেছে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
আগামী দুই বছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে বলে ধারণা করছে ইআরডি।
এদিকে, ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্পে ঋণচুক্তি সই হয়েছে এবং বাস্তবায়নে কিছুটা অগ্রগতি আছে— এসব অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেওয়া জটিল। তবে এখনই নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি বা দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়নি— এমন প্রকল্পে বাদ দেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
উন্নয়ন প্রকল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ
এদিকে, বৈদেশিক অর্থায়নের চলমান সব উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার, পরামর্শক এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ইআরডি। চিঠিতে প্রকল্পের মালামালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
গতকাল ইআরডির এই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী
একইসঙ্গে, জেলা প্রশসককে বিষয়টি নিশ্চিত করতে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগকে একই চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, জুলাই মাসে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের কারণে ভারতসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিদেশি কর্মীরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।