জাতীয় জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হবে ফসলের জাত
দেশে বিদ্যমান জিন ব্যাংক বা কৌলিসম্পদ (জেনেটিক রিসোর্সেস) সংরক্ষণকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংরক্ষণ, কার্যক্রম সমন্বয় ও কৌলিসম্পদের ক্ষতি বা হারিয়ে যাবার ঝূঁকি নিরসনের জন্য জাতীয়ভাবে কেন্দ্রীয় জিন ব্যাংকে প্রতিলিপি সংরক্ষণ করতে নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে সরকার।
এজন্য প্রণীত 'জাতীয় জীন ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০২৪'-এর খসড়া আজ বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জিন ব্যাংক হলো একটি বায়ো-রিপোজিটরি, যেখানে জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ টেকসই ব্যবহারের জন্য উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব বা এগুলোর জেনেটিক উপাদান সংগ্রহ ও দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করা হয়।
ইতিমধ্যে সরকার জাতীয় জিন ব্যাংক স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে, যার মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন নাগাদ শেষ হবে।
এই নীতিমালা কীভাবে উপকারে আসবে
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এবং ঐতিহ্যগতভাবে ফসল, বনজ, ফলজ, গবাদিপশু, মৎস্যসহ নানা প্রজাতির জার্মপ্লাজম-সমৃদ্ধ দেশ।
উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপস্থাপনের জন্য চূড়ান্ত করা খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, জার্মপ্লাজম হলো উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীব বা তাদের অংশবিশেষ বংশগত উপাদান ও উপজাতের অন্তর্গত কৌলিসম্পদ বা জেনেটিক রির্সোসেস, অথবা কোনো প্রতিবেশ ব্যবস্থার অর্ন্তগত কোনো জীবজ উপাদান যার ব্যবহার বা ব্যবহারিক মূল্য আছে।
দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ব্যবহারসহ গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রয়োগের জন্য কৌলিসম্পদ সংরক্ষণ অপরিহার্য। কৌলিসম্পদ বলতে কোনো সম্পূর্ণ উদ্ভিদ, জীব বা তার অংশবিশেষ অথবা বংশবিস্তার করতে সক্ষম অংশ—যেমন বীজ, অঙ্গজ অংশ, কলা বা কোষসমষ্টি ও জীবকোষ, জিন ও নিউক্লিক এসিড যা বংশগতিক তথ্য বহন করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানাস্তর হয়—এমন উপাদান সংরক্ষণ করা যায়।
কৌলিসম্পদ সংরক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাপী জিন ব্যাংক রয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে ১৯৭৪ সালে জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে জার্মপ্লাজম সংরক্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা শুরু হয়।
পরে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কন ব্যাংক স্থাপন করে। এতে দেশে প্ল্যান্ট জেনেটিক রিসোর্সেস (পিজিআর) সংরক্ষণ আরও সমৃদ্ধ হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উদ্ভিদ, প্রাণী, মৎস্য, অণুজীব ও কীটপতঙ্গের কৌলিসম্পদ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
দেশে বিদ্যমান জিন ব্যাংক বা কৌলিসম্পদ সংরক্ষণকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানগুলো সংরক্ষণ, কার্যক্রম সমন্বয় ও কৌলিসম্পদের ক্ষতি বা হারিয়ে যাবার ঝূঁকি নিরসনের জন্য জাতীয়ভাবে কেন্দ্রীয় জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এজন্যই জাতীয় জিন ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করছে সরকার।
২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং উন্নয়নকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। এজন্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জাতীয় উন্নয়নে কৌলিসম্পদের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০২১ সালে বাংলাদেশের ন্যাশনাল টাস্কফোর্স অন বায়োটেকনোলজির দ্বিতীয় বৈঠকে জাতীয় জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে জিন ব্যাংক প্রকল্প চালু করে।
৫০৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা প্রকল্পটি প্রথমে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা ছিল। তবে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
জাতীয় জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ বায়োটেকনোলজি।
এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে একটি অফিস ভব ও স্টাফ কোয়ার্টারসহ ৩৮ হাজার ৮১৪ বর্গফুটের একটি জিন ব্যাংকের নির্মাণকাজ চলছে। এই জিন ব্যাংকে প্রায় ৪ মিলিয়ন নমুনা সংরক্ষণ করা যাবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী ৭৪ লাখ অ্যাকসেশন রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ২০ লাখ স্বতন্ত্র ও বাকিগুলো প্রতিলিপি। এই অ্যাকসেশনগুলোকে বিশ্বব্যাপী ১ হাজার ৭৫০টিরও বেশি জিন ব্যাংক সুবিধার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। নরওয়ের বিখ্যাত ভালভার্দ গ্লোবাল সিড ভল্ট বিশ্বের সব জিন ব্যাংকের জন্য ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করে।
বৃহৎ জিন ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইআরআরআই) আন্তর্জাতিক ধান জিন ব্যাংক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধানের জিনগত বৈচিত্রের সংরক্ষণাগার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের ধানের জাত সংরক্ষণের জন্য এই জিন ব্যাংকে জমা রাখে।
নেদারল্যান্ডসের সেন্টার ফর জেনেটিক রিসোর্সেস (সিজিআর) ও ওয়াগেনিনগেন ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড রিসার্চ গরু, ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল, শূকর, কুকুর, খরগোশ ও হাঁস-মুরগির কৌলিসম্পদ সংরক্ষণের জন্য বিখ্যাত। এটি বিরল ও সাধারণ বাণিজ্যিক জাত—দুই ধরনের প্রাণীর কৌলিসম্পদই সংরক্ষণ করে।