শিরীন শারমিন চৌধুরীর পদত্যাগ: তৈরি হয়নি স্পিকার পদে শূন্যতা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করায় স্পিকার পদে শূন্যতা তৈরি হলো কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ কে করাবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী আজ সোমবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর- সেটি গৃহীত হয়েছে বলে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
সংবিধান বলছে, স্পিকারের পদত্যাগের পর এখন পর্যন্ত এই পদের দায়িত্বভার পালনে এখনো শূন্যতা তৈরি হয়নি। স্পিকারের অনুপুস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার তার দায়িত্বভার পালন করবেন। সে হিসেবে, ডেপুটি স্পিকার কারাবন্দি শামসুল হক টুকু এখনো পতদ্যাগ করেনন্ বা পদ থেকে অপসারিত হননি। সংবিধান বলছে, যদি ডেপুটি স্পিকারও তার পদে না থাকেন– তাহলে জাতীয় নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ করাবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
যেহেতু ডেপুটি স্পিকার এখনো পদে বহাল রয়েছেন, আবার দুইজনেরই অনুপস্থিতিতে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ করানোর জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এখতিয়ার দিয়েছে সংবিধান, সে হিসেবে স্পিকারের পদের কার্যক্রমের শূন্যতা তৈরি হয়নি।
স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, পদ না থাকা এবং বিভিন্ন কর্যক্রম নিয়ে বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৪ এর ২য় দফায় স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের পদ না থাকার পেছনে ৬টি কারণ উল্লেখ করা আছে। ৭৪ এর ২য় দফার উপদফা (ঘ) তে বলা হয়েছে, তিনি (স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার) যদি রাষ্ট্রপতির কাছে নিজ স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে তাঁহার পদত্যাগ করেন।
আবার একই অনুচ্ছেদের ৬ দফায় বলা আছে, "এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলী সত্ত্বেও ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তাঁহার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।" সে হিসেবে কারাবন্দি ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এখন স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন।
স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের কেউ পদে বহাল না থাকলে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ কীভাবে হবে— ২০০৬ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর তৃতীয় তফসীলে সেই সমাধান দেয়া আছে। তৃতীয় তফসীল অনুযায়ী, সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের দফা (২) এর উপদফা (ক)তে বলা হয়েছে, ''১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার অধীন অনুষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হইবার তারিখ হইতে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এই সংবিধানের অধীন এতদুদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা তদুদ্দেশ্যে অনুরূপ ব্যক্তি কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোন ব্যক্তি যে কোন কারণে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ পাঠ পরিচালনা করিতে ব্যর্থ হইলে বা না করিলে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার উহার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে উক্ত শপথ পাঠ পরিচালনা করিবেন, যেন এই সংবিধানের অধীন তিনিই ইহার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি।"
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া টিবএসকে বলেন, 'স্পিকারের পদত্যাগের ফলে সংবিধান অনুযায়ী, এই পদের কার্যাভার বা এখতিয়ার পালনে কোনো শূণ্যতা তৈরি হয়নি। কারণ সংবিধান বলেছে, স্পিকার না থাকলে ডেপুটি স্পিকার তার দায়িত্ব পালন করবেন। আবার ডেপুটি স্পিকার না থাকলে– জাতীয় সংসদ একজন এমপিকে দায়িত্ব পালনে মনোনীত করবেন। যেহেতু, সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, তাই এমপিরা পদে নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ করানো নিয়ে যে জটিলতার কথা বলা হচ্ছে, সেটার সমাধান সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের দফা (২) এর উপদফা (ক)-তে দেওয়া আছে। ফলে এটি স্পষ্ট স্পিকারের পদের কার্যভারের কোনো শূন্যতা তৈরি হয়নি।'
২০১৩ সালে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পরে স্পিকারের পদ থেকে রাষ্ট্রপতি করা হয় আবদুল হামিদকে। তার জায়গায় স্পিকার পদে শিরীন শারমিন চৌধুরীকে মনোনীত করে অনেককেই বিস্মিত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে মাত্র ৪৬ বছরের শিরীন জাতীয় সংসদের প্রথম নারী স্পিকারের পাশাপাশি ও সর্বকনিষ্ঠ স্পিকারও হয়েছিলেন। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হন শিরীন। এরপর তাঁকে নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের একজন সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন শিরীন শারমিনের বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী, মূলত একারণেই হাসিনা তাকে স্পিকার হিসেবে বেঁছে নেন বলে ধারণা করা হয়।
২০১৪ সালের একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে আবারো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর শেখ হাসিনা তার রংপুর-৬ আসন ছেড়ে দিলে– শিরীন শারমিনের জন্মস্থান নোয়াখালী হলেও তিনি উত্তরাঞ্চলের ওই আসনে উপ-নির্বাচনে অংশ নেন, এবং ২৮ জানুয়ারি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ওই উপ-নির্বাচনে জয়ী হন। একইদিনে তাঁকে দশম জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ।
রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সাজানো – ২০১৮ ও ২০২৪ সাল্লের আরও দুটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শিরীন শারমিন চৌধুরী। হাসিনার ইচ্ছায় দুইবারই তাকে স্পিকার হিসাবে নির্বাচিত করা হয়।
শিরীন শারমিন তার প্রতিদানও দিয়েছেন– হাসিনার প্রতি তার আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। দায়িত্ব পালনের সময় তিনি সংসদের চেয়েও বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন দলকে। সরকারি অনেক অনুষ্ঠানে তাকে শেখ হাসিনার উন্নয়নের বয়ানের প্রশংসা করতে শোনা গেছে।