অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিতে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার ১৩ প্রকল্প পুনঃমূল্যায়ন
আগের শেখ হাসিনা প্রশাসনের নেওয়া ১৩টি বড় প্রকল্প পুনঃমূল্যায়নের পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব প্রকল্পে মোট ৫২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, এরমধ্যে চারটি প্রকল্প চলমান, যেগুলোর সংশোধিত প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে, আর প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্প রয়েছে ৯টি।
পুনঃমূল্যায়নের উদ্দেশ্য হলো – যেসব প্রকল্পে সুফল পাওয়া যাবে না, বা এই মুহুর্তে করা জরুরি নয় – সেগুলো বাদ দেওয়া। আবার কিছু প্রকল্পের অগুরুত্বপূর্ণ অঙ্গও বাদ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
কর্মকর্তারা জানান, নতুন প্রকল্পগুলোতে ২১ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে, চলমান চার প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ২০ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, যা বাড়িয়ে ৩১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছিল আগের সরকার।
পরিকল্পনা কমিশনের অধীন ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সুলেমান খান বলেন, "এই ১৩ প্রকল্প একনেক বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করে পাঠানো হয়েছিল আগের সরকারের সময়ে। এখন এসব প্রকল্প নতুন করে মূল্যায়ন করা হবে। তারপর প্রকল্পগুলোর যৌক্তিকতা, ব্যয় এবং বিভিন্ন অঙ্গের পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা আরও জানান, চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা এই ১৩ প্রকল্পই কেবল নয়, বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে থাকা প্রকল্প বাদে— আগের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের নেওয়া প্রায় সব প্রকল্পই নতুন করে মূল্যায়ন করা হবে। প্রকল্পগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে এগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তবর্তী সরকারের কাছে পাঠানো হবে। যেসব প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া বা যেসব অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প – সেগুলো এখন পুনঃমূল্যায়ন করা হবে।
বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিবি) চলমান প্রকল্প রয়েছে, ১ হাজার ৩২৬টি। এছাড়া অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পের সংখ্যা প্রায় ১,২০০।
পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, "আগের সরকারের অনেক প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে, ব্যয় বা বিভিন্ন অঙ্গ নিয়ে কমিশনের আপত্তি ছিল। কিন্তু, আমাদের আপত্তি থাকলেও ওই সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিভিন্ন চাপে কাজ করতে হয়েছে। ফলে অনেক প্রকল্পের বিষয়ে সন্তুষ্ট না হলেও— অনুমোদন দিতে বাধ্য হয় পরিকল্পনা কমিশন। একারণে চলমান প্রকল্পগুলো পুনরায় মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।"
গত ১৯ আগস্ট পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা গোষ্ঠী স্বার্থে নেওয়া প্রকল্প যাচাই-বাছাই শেষে ছাটাই করা হবে।
তিনি বলেন, "চলমান ও প্রস্তাবিত প্রত্যেক প্রকল্প, ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ এখানে অনেক বিশৃঙ্খলা (অব্যবস্থাপনা) রয়েছে। … চলমান কোনো প্রকল্পে কিছু অর্থ ব্যয় হয়ে গেলেই, ওই প্রকল্প শেষ করতেই হবে, অর্থনীতিতে এ যুক্তি খাটে না। এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে যৌক্তিক বিবেচনা হলো, কত খরচ করেছি, তাতে কিছু আসে যায় না। বাকি কত খরচ করতে হবে এবং পুরো প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে কিনা – এটাই মূল বিষয়। অর্থনীতিতে একে নিমজ্জিত ব্যয় বলা হয়।"
১৩ প্রকল্পের সারসংক্ষেপ
পুনঃমূল্যায়নের তালিকায় থাকা একটি প্রকল্প হলো: ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প। প্রকল্পটি প্রথমে ২০১৭ সালে ১ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একনেকে অনুমোদন হয়। নতুন করে সংশোধিত প্রস্তাবে ব্যয় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকরতারা জানান, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ করবে কিনা– সে বিষয়ে পর্যালোচনা করবে সরকার। তাছাড়া ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় প্রস্তাব বড় ধরণের পরিবর্তন হয়েছে। এ বিষয়েও কোনো অনিয়ম আছে কিনা– তা পর্যালোচনা করা হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালে যখন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল – তখন এই সড়কের দুই পাশে ১২০ ফুট সড়কের জায়গা আছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু, বাস্তবায়নে গিয়ে দেখা যায়– রাস্তার দুই পাশে সড়কের জায়গা আছে ৬০ ফুট। এছাড়া এই প্রকল্পে যখন নেওয়া হয়েছিল, তখন ক্ষতিগ্রস্তদের দেড়গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম ছিল। কিন্তু, এখন তিনগুণ দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে।
১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণের বিষয়ে নতুনকরে মূল্যায়ন করা হবে। প্রকল্পটির ব্যয় পর্যালোচনা করা হবে। এই প্রকল্পে দ. কোরিয়ার ৮১৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে।
মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। সংশোধিত প্রস্তাবে নতুন করে প্রকল্প ব্যয় ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির এ প্রস্তাবকে ওই সময় অস্বাভাবিক বলেছিল পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পরও – প্রকল্পের মাঝপথে বড় আকারের ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাবটি অযৌক্তিক। জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার (জাইকা) মাধ্যমে এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছিল। তবে সংশোধিত প্রস্তাবে ব্যয় বাড়ার দায় চাপানো হয়েছে – ডলারের দাম এবং প্রকল্পের কিছু আইটেমের মূল্য বৃদ্ধির ওপরে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, অন্যান্য দেশের বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পের চেয়ে বাংলাদেশের একই ধরনের প্রকল্পগুলোর ব্যয় অধিকাংশক্ষেত্রেই বেশি ধরা হয়েছে। যেমন ইন্দোনেশিয়ার মেট্রোরেল প্রকল্পেও জাপান অর্থায়ন করেছে, কিন্তু এর ব্যয় বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পের চেয়ে কম।
তিনি বলেন, "প্রতিবেশী অনেক দেশও এধরনের প্রকল্প অনেক কম খরচে বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু, ঠিকাদাররা যখন আমাদের প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারে, তখন ব্যয় বেড়ে যায়। একই পরিমাণ বিদেশি ঋণ দিয়ে অন্যান্য দেশ আরও প্রকল্প করছে।"
র্যাব ফোর্সেস সদর দপ্তর নির্মাণের চলমান প্রকল্পটির সংশোধিত ব্যয় প্রস্তাবও পর্যালোচনা করা হবে। প্রকল্পটিতে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৫০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত প্রস্তাবে ৬৯১ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া চিলমারী এলাকায় নদীবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ১০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩৩৫ কোটি টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
পুনঃমূল্যায়নের অধীন অন্যান্য নতুন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, ৯৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ (৩য় পর্যায়); ৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা ব্যয়ে রেজিলিয়েন্ট আরবান এ্যান্ড টেরিটরিয়াল ডেভেলপমেন্ট (আরইউটিডিপি) প্রজেক্ট এবং ১ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কসমূহ উন্নয়ন।
এছাড়া অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে আছে — ৪৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গাছবাড়িয়া-শোলকাটা-কালাবিবির দীঘি সড়ক উন্নয়ন; ৪২১ কোটি টাকা ব্যয়ে মোংলা-বৌদ্ধমারী বাজার জেলা মহাসড়ক উন্নয়নন; ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদনের মাধ্যমে টেকসই পুষ্টি নিরাপত্তা জোরদারকরণ; ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে কর্মচারীদের আবাসিক ভবন নির্মাণ, এবং ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ প্রকল্প ।