গাজীপুরে দুই হত্যা মামলায় শেখ হাসিনা, কাদেরসহ আসামি সহস্রাধিক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট বিকালে গাজীপুরের শ্রীপুরে বিজিবির সদস্যদের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিতে ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছিলেন। এ ঘটনায় নিহত দুই জনের স্বজনরা গেল বুধবার রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর মডেল থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
মামলা দুটিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ্ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সা্বেক ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশিদ, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমের নাম আসামীর ঘরে উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি মামলায় ৯৫ জনের নাম উল্লেখসগহ অজ্ঞাত আরো ১,১০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
নিহতরা হলেন, গাজীপুরের শ্রীপুর থানার কপাটিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেন রানা (৩৫) ও অপরজন, বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি থানার জামথল এলাকার বাসিন্দা মো: মুঞ্জু মিয়ার ছেলে রহমত মিয়া (২০)। পর পর দায়ের করা দুটি মামলায় ছেলে হত্যার বিচার দাবিতে একটির বাদী জামাল উদ্দিন, অপর মামলার বাদী মো. মঞ্জু মিয়া।
শ্রীপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম সোহেল রানা মামলা রুজু হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরও জানান, বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মামলাটি রুজু হয়েছে।
তিনি আরও জানান, জামাল উদ্দিনের মামলায় উল্লেখিত কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ ৩৫ জন জ্ঞাত ও আরও ৪০০/৫০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
অপরদিকে, মো. মঞ্জু মিয়ার মামলায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, শ্রীপুরের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলীর মেয়ে ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী টুসি ও ছেলে শ্রীপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জামিল হাসান দুর্জয়, সাবেক এমপি ইকবাল হোসেন সবুজসহ ৬০ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৫০০/৬০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
দুটি মামলাতেই অভিযোগ করা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রজনতাকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে এক দফাসহ যৌক্তিক দাবি নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বিজিবি সদস্যদের ঢাকাতে সমবেত করার সিদ্ধান্ত নেয় বিগত স্বৈরাচারী সরকার। ছাত্র আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল ঠিক তখন ছাত্র-আন্দোলন নস্যাৎ করার পরিকল্পনায় সরকারের নির্দেশনা পেয়ে একাধিক বাসে করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন ক্যাম্পে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যগণ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বিজিবি সদস্যদের বহনকারী বাসগুলো গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উপর (পল্লী বিদ্যুৎ ও বাংলাদেশ এনার্জি সেন্টার) সামনে পৌঁছালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখোমুখি হয়।
উক্ত বিজিবি সদস্যদের দিয়ে ঢাকার ছাত্র-জনতার আন্দোলন হটানো হবে, তাদের আটকে রাখা হয়েছে, মর্মে খবর প্রকাশ হলে বিগত স্বৈরাচার সরকারের দলীয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এসময় বিজিবি সদস্যদের ঢাকায় পাঠাতে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিজিবি সদস্যদের সাথে থাকা অস্ত্র, গুলি ছিনিয়ে নিয়ে এবং কিছু অতি উৎসাহিত বিজিবি সদস্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সহযোগীতায় ঘটনার দিন আসামিগণ অতি উৎসাহিত বিজিবি সদস্যদের নিয়ে ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে মামলার ভিকটিমগণ নিহত হয়েছেন।
দুটি এজাহার থেকে দেখা যায়, মামলা দুটিতে ঘটনার তারিখ ও স্থান একই উল্লেখ করা হলেও ঘটনার সময় ও হত্যার বর্ণনা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জামাল উদ্দিন তার মালায় আরও অভিযোগ করেছেন, বিজিবি সদস্যদের ঢাকায় পাঠাতে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিজিবি সদস্যদের সাথে থাকা অস্ত্র, গুলি ছিনিয়ে নেয় এবং কিছু অতি উৎসাহিত বিজিবি সদস্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সহযোগীতায় ৫ আগস্ট বিকেল আনুমানিক ৪টার সময় ১ থেকে ১২ নম্বর আসামীদের নির্দেশক্রমে ১৩ থেকে ৩৭ নম্বর আসামিগণ অতি উৎসাহিত বিজিবি সদস্যদের নিয়ে ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় আওয়ামীলীগ ও তাদের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলিতে আন্দোলনে থাকা জাকির হোসেন রানা বুকের মাঝামাঝি গুলিবিদ্ধ হয়। তাৎক্ষণিক ভাবে জাকির হোসেন রানা কে উদ্ধার করে কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামের প্রশিকা মোড় এলাকার আল হেরা মেডিকেল সেন্টারে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। আমরা উক্ত হাসপাতাল থেকে তার লাশ গ্রহণ করে মাওনা ফায়ার সার্ভিসের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে।
মো. মুঞ্জু মিয়া (৫৪) তার মামলায় বলেছেন, তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে গাজীপুরের শিরির চালা এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। তার ছোট ছেলে রহমত মিয়া (২০) জীবিকার তাগিদে বগুড়া থেকে গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার শিরিরচালা গ্রামে এসএম নীটওয়্যারস্ লিমিটেড সুইং অপারেটর পদে চাকরি করতো।
উল্লেখিত ঘটনার দিন বিজিবি সদস্যদের ঢাকায় পাঠাতে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ১ থেকে ১৬ নামীয় আসামিদের নির্দেশে ১৭ থেকে ৬০ ও অজ্ঞাতনামা আসামীগণ ঘটনার দিন ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিজিবি সদস্যদের সাথে থাকা অস্ত্রগুলি ছিনিয়ে ও উপস্থিত আসামীগণদের নিকট থাকা অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা এজাহারনামীয় ২৬নং আসামি হারুন অর রশিদ ওরফে বাঘ বাদল ও ৪৪নং এজাহারনামীয় আসামি রাসেল শেখের হাতে থাকা বিদেশি অস্ত্রের গুলিতে আন্দোলনে থাকা রহমত মিয়া ডান হাতের নিচে বুকের পাঁজরে বিদ্ধ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে রহমত মিয়াকে উদ্ধার করে কেওয়া পশ্চিম খণ্ড গ্রামের প্রশিক্কা মোড় এলাকার আল হেরা মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।