মুরগির চেয়ে ডিমের দাম যখন বেশি!
বগুড়ার বাজারে প্রতিপিস মুরগির ডিমের দাম সাড়ে ১২ টাকা। আর গত শনিবার (২৪ আগস্ট) সোনালী মুরগির একদিন বয়সী বাচ্চা পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে ১১ টাকা করে। একই সময়ে হ্যাচারি মালিকরা এরচেয়ে কম দামে বাচ্চা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
হ্যাচারি মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সোনালী জাতের একটি বাচ্চা উৎপাদন করতে যে ডিমের দরকার হয়, তার দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে। ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনের প্রক্রিয়া শেষ করতে খরচ হয় প্রায় ২০ টাকা। অথচ এখন বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা দরে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর বন্যা মিলিয়ে ব্যবসার পরিস্থিতি খুব খারাপ বলে জানান গাইবান্ধার শেফালি পোল্ট্রি প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, "এখন প্রতিটি ডিমের দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকা। ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনে খরচ পড়ে প্রায় ২০ টাকা। অথচ বিক্রি করতে হচ্ছে ১০ টাকা দরেও।"
শেফালি পোল্ট্রি সপ্তাহে ৫০ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করে জানিয়ে মিজানুর রহমান আরও বলেন, "বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে মুরগীর বাচ্চার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। লোকসানের ওপর লোকসান হচ্ছে। ২৬ আগস্টেও প্রতিপিস বাচ্চা বিক্রি করতে হয়েছে ১৩ থেকে ১৪ টাকা। বাচ্চা বিক্রি করে এখন তো ডিমের দামই উঠছে না। পাইকারি বাজারেও অবস্থা বেশ নাজুক।"
জয়পুরহাটকে সোনালী মুরগির উৎপাদনস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেলার প্রায় ৫০ শতাংশ জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পোল্ট্রি শিল্প তথা সোনালী মুরগির বাচ্চা, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। সম্ভাবনাময় এ শিল্পের দ্রুত উত্থানে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নতুন নতুন পোল্ট্রি ফার্ম ও হ্যাচারি।
পোল্ট্রি ভিলেজ খ্যাত জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার জামালগঞ্জে ১৯৭৩ সালে প্রায় ১১ একর জমির ওপর নির্মিত হয় সরকারি হাঁস-মুরগির খামার। সেই থেকে শুরু হয় পোল্ট্রি শিল্পের এগিয়ে চলা। সোনালী জাতের এই মুরগির উদ্ভাবন এখানেই।
জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য মতে, এই শিল্পকে কেন্দ্র করেন বর্তমানে জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১১ হাজার পোল্ট্রি খামার গড়ে উঠেছে। আর বাচ্চা উৎপাদনের জন্য ৮০টি হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। জেলায় বছরে মুরগির বাচ্চার চাহিদা ৪.৫০ কোটি। কিন্তু এখানে উৎপাদন ৮.৫০ কোটি।
অর্থাৎ জেলায় প্রয়োজনের চেয়ে ৪ কোটি পিস বেশি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয়। এগুলো বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এসব মুরগির বাচ্চা নিয়েই এখন বিপদে পড়েছে হ্যাচারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
জয়পুরহাটের জামালগঞ্জের মুরগির বাচ্চা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বগুড়ার 'পোল্ট্রি মার্কেট' হিসেবে পরিচিত চকসুত্রাপুরে। ব্যবসায়ীরা জানান, গত ২১ আগস্ট সোনালী মুরগির বাচ্চা বিক্রি হয়েছে ১৬ টাকা পিস হিসেবে। ২২ আগস্টে ১৩ টাকা, ২৪ আগস্টে ১১ টাকা এবং ২৫ আগস্টে বিক্রি হয়েছে ১৩ টাকা করে। স্বাভাবিক সময়ে সোনালী জাতের প্রতি পিস মুরগি ২৫ টাকার উপরে বিক্রি হয়।
তবে গত কয়েকদিন বেশি খারাপ গেলেও ২৬ আগস্টে প্রতি পিস মুরগির বাচ্চা ১৪ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। হাইব্রিড সোনালীর স্বাভাবিক বাজার ৩০ টাকার উপরে হলেও বগুড়ায় বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকার নিচে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ী ও হ্যাচারি মালিকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সপ্তাহে গড়ে এক লাখ পিসের বেশি সোনালী জাতের মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করে জয়পুরহাটের এসএসবি পোল্ট্রি কমপ্লেক্স অ্যান্ড হ্যাচারি। এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন বাবু বলেন, "এখন ১১ থেকে ১২ টাকা করে বাচ্চা বিক্রি করা হচ্ছে। আমাদেরও উপায় নেই। কারণ এসব ডিমও আমাদের উৎপাদিত।"
"লোকসানের মুখে বাচ্চা উৎপাদন বন্ধেরও কোনো সুযোগ নেই, কারণ এখানে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তাদেরও জীবন আছে। চলতে হবে। আবার খামারিকেও বাঁচাতে হবে," যোগ করেন তিনি।
মুরগির ব্যবসার সাথে জড়িতরা বলছেন, বাজার এখানে ডাউন হওয়ার কারণে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বগুড়া পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি প্রতিদিন অন্তত ৭০ হাজার পিস মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে।
প্রতিষ্ঠানের মালিক শাকিল আহমেদ বলেন, "রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাচ্চার দাম কমে গেছে। এ কারণে গত ৫ আগস্টে ৯ লাখ টাকা লোকসানে পড়তে হয়েছে। এরমধ্যে আবার বন্যা শুরু হয়েছে দেশের পূর্বাঞ্চলে। এতে আমরা আরও ক্ষতির মুখে পড়েছি।"
তিনি আরও বলেন, "জয়পুরহাটের সোনালী মুরগির বাচ্চার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক হাব বগুড়ায়। এখানে প্রতিদিন এক থেকে দেড় কোটি টাকার লেনদেন হয়। গুণগত মান ভালো হওয়ার কারণে আমাদের এখানকার বাচ্চা দেশের সব জেলাতেই যায়। আমরাও চাই ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করুক। না হলে অনেক উদ্যোক্তা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।"
বগুড়ায় একদিনের বাচ্চা বিক্রি ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা তৌফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, "হঠাৎ করে অনেক উদ্যোক্তা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ খেলাপিও হয়েছেন। লোকসানের মুখে বগুড়ার অনেক হ্যাচারি মালিক তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। মুরগির বাচ্চার দাম স্বাভাবিক থাকলে এখনও যারা আছেন, তারা ভালো থাকবেন।"