পানি কমে যাওয়ায় দৃশ্যমান হচ্ছে বন্যার ক্ষত
দেশের পূর্বাঞ্চলে হওয়া বন্যার অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত ফেনীর পরশুরাম উপজেলার অধিকাংশ রাস্তা ও বাড়ি থেকে পানি নেমেছে গত তিনদিনে। কিন্তু প্রধান সড়কসহ বেশিরভাগ রাস্তাই এখন চলাচলের অনুপযোগী।
অধিকাংশ কাঁচা বাড়ি মাটির সাথে মিশে গিয়েছে, পানিতে ভাসছে মৃত গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী। চারিদিকে এসব মৃত জীব জন্তুর দুর্গন্ধ, আবার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে ঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না ত্রাণ সামগ্রী।
শুধু ফেনীর পরশুরামই নয়, দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলার ৭৪ উপজেলার ৫৪১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৫৬ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতির শিকার।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে ১১ জেলায় পানিবন্দি পরিবার ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি। মঙ্গলবার পর্যন্ত বন্যায় মোট ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১০ জন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে ৫ জন, খাগড়াছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে ৫ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছেন।
ফেনীসহ বন্যাকবলীত এলাকাগুলোতে মানুষের ডায়রিয়াসহ শরীরে খোস-পাচরা ছড়িয়ে পড়েছে।
পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার দুইটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা দলীয় ব্যানারে ত্রাণ দিচ্ছেন। স্থানীয় বিত্তশালীরা ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু এলাকায় ত্রাণ দিয়েছেন। এছাড়া, কিছু স্বেচ্চাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। তবে সবাই সমানভাবে ত্রাণ পাচ্ছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো আছে, এমন এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ পেলেও দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছায়নি।
ফুলগাজী উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন আমজাদ হাট। বন্যায় এই এলাকার কয়েকটি গ্রাম বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরেজমিনে দক্ষিণ তালবাড়িয়া গ্রামে দেখা যায়, পানি নেমে যাওয়ায় বন্যার ভয়াবহতার চিত্র দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে। গাছপালা উপড়ে পড়ে আছে।
ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ তালবাড়িয়ার বাসিন্দা সবিয়া খাতুন (৬৫)। সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় তার টিনের ঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সবিয়া খাতুন জানান, বিগত ৪০-৪৫ বছরের মধ্য তার বাড়িতে পানি ওঠেনি। ফলে তার ধারণা ছিল পানি উঠবে না। কিন্তু স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তার ঘর ডুবে যায়। পরে বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়ে পাশে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন সবিয়া।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "দুদিন ওই বাড়িতে যে খাবার ছিল সেটি আমাদের খাওয়ানো হয়। কিন্তু ওই বাড়িতে ত্রাণ আসেনি। এমনকি গত দুইদিন বাড়িতে এসেছি। তাও কোনো ত্রাণ পাইনি। পাশের এক আত্মীয় খাওয়াচ্ছে।"
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত ৫ দিনের মধ্যে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী সোমবার বাড়ি বাড়ি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। এর বাইরে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো ত্রাণ আসেনি।
মো. জনি নামে এক বাসিন্দা বলেন, "বন্যায় আমাদের মাটির ঘর ভেঙে পড়েছে। এতদিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। সেখানে এলাকাবাসী সহায়তায় রান্না করে খাবার দেওয়া হয়েছে। রোববার বাড়িতে এসেছি। পাশ্ববর্তী এক প্রতিবেশীর বাড়িতে থাকছি।"
"এক ইঞ্জিনিয়ার ভাই গতকাল ত্রাণ দিয়েছেন। এর বাইরে কিছুই পাইনি," যোগ করেন তিনি।
পরশুরাম উপজেলায় স্থানীয় লোকজন বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা মিলে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা নিজেরা ফান্ড তুলে যতটুকু পেরেছেন, মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।
জানতে চাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়াস্তি উল ইসলাম বলেন, "আমরা বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা মেডিসিন, মোমবাতি পৌঁছে দিয়েছি। বিভিন্ন স্কুল ভবনে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ত্রাণ নিয়ে এসেছে এখানে। তবে সরকারিভাবে এখনও কোনো ত্রাণ আসেনি।"
"আজ আমাদের একটি টিম উপজেলায় গিয়ে ইউনওর সাথে কথা বলেছি। তিনি একটি আনুমানিক হিসাবের তালিকা চেয়েছেন ও সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা তালিকা করতে গিয়ে দেখেছি যেসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো, সেখানে অনেকে একাধিকবারও ব্যক্তি উদ্যোগে আসা ত্রাণ পেয়েছেন। কিন্তু যেগুলো একেবারে প্রত্যন্ত এলাকা সেখানে এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি," জানান তিনি।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গোমতী নদীর কুমিল্লা পয়েন্টে পানির স্তর বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপরে এবং অন্যান্য নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে রয়েছে।
এদিকে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে এবং গঙ্গা-পদ্মা নদী স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি এবং নোয়াখালীতে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।